প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
যে প্রেমের কোনো বন্ধন নাই, কোনো নিয়ম নাই, যাহা অকস্মাৎ নরনারীকে অভিভূত করিয়া সংযমদুর্গের ভগ্নপ্রাকারের উপর আপনার জয়ধ্বজা নিখাত করে, কালিদাস তাহার শক্তি স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু তাহার কাছে আত্মসমর্পণ করেন নাই। তিনি দেখাইয়াছেন, যে অন্ধ প্রেমসম্ভোগ আমাদিগকে স্বাধিকারপ্রমত্ত করে তাহা ভর্তৃশাপের দ্বারা খণ্ডিত, ঋষিশাপের দ্বারা প্রতিহত ও দেবরোষের দ্বারা ভস্মসাৎ হইয়া থাকে। শকুন্তলার কাছে যখন আতিথ্যধর্ম কিছুই নহে, দুষ্মন্তই সমস্ত, তখন শকুন্তলার সে প্রেমে আর কল্যাণ রহিল না। যে উন্মত্ত প্রেম প্রিয়জনকে ছাড়া আর সমস্তই বিস্মৃত হয় তাহা সমস্ত বিশ্বনীতিকে আপনার প্রতিকূল করিয়া তোলে, সেইজন্যই সে প্রেম অল্প দিনের মধ্যেই দুর্ভর হইয়া উঠে, সকলের বিরুদ্ধে আপনাকে আপনি সে আর বহন করিয়া উঠিতে পারে না। যে আত্মসংবৃত প্রেম সমস্ত সংসারের অনুকূল, যাহা আপনার চারি দিকের ছোটো এবং বড়ো, আত্মীয় এবং পর, কাহাকেও ভোলে না, যাহা প্রিয়জনকে কেন্দ্রস্থলে রাখিয়া বিশ্বপরিধির মধ্যে নিজের মঙ্গলমাধুর্য বিকীর্ণ করে, তাহার ধ্রুবত্বে দেবে মানবে কেহ আঘাত করে না, আঘাত করিলেও সে তাহাতে বিচলিত হয় না। কিন্তু যাহা যতির তপোবনে তপোভঙ্গরূপে, গৃহীর গৃহপ্রাঙ্গণে সংসারধর্মের অকস্মাৎ পরাভবস্বরূপে আবির্ভূত হয়, তাহা ঝঞ্ঝার মতো অন্যকে নষ্ট করে বটে, কিন্তু নিজের বিনাশকেও নিজেই বহন করিয়া আনে।
পর্যাপ্তযৌবনপুঞ্জে অবনমিতা উমা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতার ন্যায় আসিয়া গিরিশের পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হইয়া প্রমাণ করিলেন, তাঁহার কর্ণ হইতে পল্লব এবং অলক হইতে নবকর্ণিকার বিচ্যুত হইয়া পড়িয়া গেল। মন্দাকিনীর জলে যে পদ্ম ফুটিত, সেই পদ্মের বীজ রৌদ্রকিরণে শুষ্ক করিয়া নিজের হাতে গৌরী যে জপমালা গাঁথিয়াছিলেন সেই মালা তিনি তাঁহার তাম্ররুচি করে সন্ন্যাসীর হস্তে সমর্পণ করিলেন। হাতে হাতে ঠেকিয়া গেল। বিচলিতচিত্ত যোগী একবার উমার মুখে, উমার বিম্বাধরে তাঁহার তিন নেত্রকেই ব্যাপৃত করিয়া দিলেন। উমার শরীর তখন পুলকাকুল, দুই চক্ষু লজ্জায় পর্যস্ত এবং মুখ এক দিকে সাচীকৃত।
কিন্তু অপূর্ব সৌন্দর্যে অকস্মাৎ উদ্ভাসমান এই-যে হর্ষ দেবতা ইহাকে বিশ্বাস করিলেন না, সরোষে ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। নিজের ললিতযৌবনের সৌন্দর্য অপমানিত হইল জানিয়া লজ্জাকুন্ঠিতা রমণী কোনোমতে গৃহে ফিরিয়া গেলেন।
কণ্বদুহিতাকেও একদিন তাঁহার যৌবনলাবণ্যের সমস্ত ঐশ্বর্যসম্পদ লইয়া অপমানিত হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। দুর্বাসার শাপ কবির রূপকমাত্র। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বন্ধহীন গোপন মিলন চিরকালের অভিশাপে অভিশপ্ত। উন্মত্ততার উজ্জ্বল উন্মেষ ক্ষণকালের জন্যই হয়; তাহার পরে অবসাদের, অপমানের, বিস্মৃতির অন্ধকার আসিয়া আক্রমণ করে। ইহা চিরকালের বিধান। কালে কালে দেশে দেশে অপমানিতা নারী ‘ব্যর্থং সমর্থ্য ললিতং বপুরাত্মনশ্চ' আপনার ললিত দেহকান্তিকে ব্যর্থ জ্ঞান করিয়া, ‘শূন্যা জগাম ভবনাভিমুখী কথঞ্চিৎ' শূন্যহৃদয়ে কোনোক্রমে গৃহের দিকে ফিরিয়াছে। ললিত দেহের সৌন্দর্যই নারীর পরম গৌরব, চরম সৌন্দর্য নহে।
সেইজন্যই ‘নিনিন্দ রূপং হৃদয়েন পার্বতী', পার্বতী রূপকে মনে মনে নিন্দা করিলেন। এবং ‘ইয়েষ সা কর্তুমবন্ধ্যরূপতাম্', তিনি আপনারা রূপকে সফল করিতে ইচ্ছা করিলেন। রূপকে সফল করিতে হয় কী করিয়া? সাজে সজ্জায় বসনে অলংকারে? সে পরীক্ষা তো ব্যর্থ হইয়া গেছে।-