প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
লোকেশ্বরী। আছে, যখন সে ডোবায়। যখন সে দৃঢ় করে বাঁধে তখন না। পর্বতকে সৃষ্টিকর্তা নির্দয় পাথর দিয়ে গড়েছেন, পাঁক দিয়ে নয়। তোমাদের গুরুর কৃপায় উপর থেকে নিচে পর্যন্ত সবই কি হবে পাঁক? রাজবাড়িতে মানুষ হয়েও এই কথাটা মানতে ঘৃণা হয় না? চুপ করে রইলে যে?
বাসবী। ভেবে দেখছি, মহারানী।
লোকেশ্বরী। ভাববার কী আছে। চোখের সামনে দেখলে তো রাজপুত্র একমুহূর্তে রাজা হতে ভুলে গেল। বলে গেল চরাচরকে দয়া করবার সাধনা করব। শোননি, বাসবী?
বাসবী। শুনেছি।
লোকেশ্বরী। তাহলে নির্দয়তা করবার গুরতর কাজ গ্রহণ করবে কে? কেউ যদি না করে তবে বীরভোগ্যা বসুন্ধরার কী হবে গতি? যত-সব মাথা-হেঁট-করা উপবাসজীর্ণ ক্ষীণকণ্ঠ মন্দাগ্নিম্লান নির্জীবের হাতে তার দুর্গতির কি সীমা থাকবে? তোরা ক্ষত্রিয়ের মেয়ে, কথাটা তোদের কাছে এত নতুন ঠেকছে কেন বাসবী!
বাসবী। এই পুরানো কথাটা হঠাৎ আজ যেন একদিনে ঢাকা পড়ে গেছে, বসন্তে নিষ্পত্র কিংশুকের শাখা যেমন করে ফুলে ঢেকে যায়।
লোকেশ্বরী। কখনো কখনো বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে পুরুষ আপন পৌরুষধর্ম ভুলে যায়, কিন্তু নারীরা যদি তাকে সেটা ভুলতে দেয় তাহলে মরণ যে সেই নারীর। মহালতার জন্যে কি মহাবৃক্ষের দরকার নেই! সব গাছই গুল্ম হয়ে গেলে কি তার পক্ষে ভালো? বল না। মুখে যে উত্তর নেই।
বাসবী। মহাবৃক্ষ চাই বই কি।
লোকেশ্বরী। কিন্তু বনস্পতি নির্মূল করবার জন্যই এসেছেন তোমাদের গুরু। তাও যে পরশুরামের মতো কুঠার হাতে করবেন এমন শক্তি নেই। কোমল শাস্ত্রবাক্যের পোকা তলায় তলায় লাগিয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের মজ্জাকে জীর্ণ করবেন, বিনা যুদ্ধে পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করে দেবেন। তাঁদেরও কাজ সারা হবে আর তোমরা রাজার মেয়েরা মাথা মুড়িয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে পথে পথে ফিরবে। তার আগেই যেন মর, আমার এই আশীর্বাদ। কী ভাবছ? কথাটা মনে লাগছে না?
বাসবী। ভালো করে ভেবে দেখি।
লোকেশ্বরী। ভেবে দেখবার দরকার নেই, প্রমাণ দেখো। আর্যপুত্র বিম্বিসার, ক্ষত্রিয় রাজা, রাজত্ব তো তাঁর ভোগের জিনিস নয়, তাতেই তাঁর ধর্মসাধনা। কিন্তু কোন্ মরুর ধর্ম কানে মন্ত্র দিলে অমনি কত সহজেই রাজত্ব থেকে তিনি খসে পড়লেন— অস্ত্র হাতে না, রণক্ষেত্রে না, মৃত্যুর মুখে না। বাসবী, একদিন তুমিও রাজার মহিষী হবে এ আশা কি ত্যাগ করেছ?
বাসবী। কেন ত্যাগ করব?
লোকেশ্বরী। তাহলে জিজ্ঞাসা করি দয়া-মন্ত্রের হাওয়ায় যে-রাজা সিংহাসনের উপর কেবল টলমল করে, রাজদণ্ড যার হাতে শিথিল, জয়তিলক যার ললাটে ম্লান, তাকে শ্রদ্ধা করে বরণ করতে পারবে?
বাসবী। না।
লোকেশ্বরী। আমার কথাটা বলি। মহারাজ বিম্বিসার সংবাদ পাঠিয়েছেন তিনি আজ আসবেন। তাঁর ইচ্ছা আমি প্রস্তুত থাকি। তোমরা ভাবছ ওঁর জন্যে সাজব! যে-মানুষ রাজাও নয় ভিক্ষুও নয়, যে-মানুষ ভোগেও নেই ত্যাগেও নেই, তাকে অভ্যর্থনা! কখনো না। বাসবী, তোমাকে বার বার বলছি, এই পৌরুষহীন আত্মাবমাননার ধর্মকে কিছুতে স্বীকার করো না।