প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
যে দেশে পার্লামেন্ট আছে, সে দেশেও এডুকেশন-বিল লইয়া ঘোরতর বাদ-বিবাদ চলিয়াছিল—কিন্তু দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে কি কোনো লোক স্বপ্নেও এমন সন্দেহ করিতে পারিত যে, যেহেতু শিক্ষালাভের একটা অনিবার্য ফল এই যে, ইহার দ্বারা লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংকীর্ণতা পরিহার করে, নিজের শক্তি সম্বন্ধে তাহার মন সচেতন হইয়া ওঠে এবং সেই শক্তি প্রয়োগ করিবার ক্ষেত্র বিস্তার করিতে সে ব্যগ্র হয়, অতএব এতবড়ো বালাইকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো। কখনোই নহে, উভয় পক্ষই এই কথা মনে করিয়াছিল যে, দেশের মঙ্গলসাধন সম্বন্ধে পরস্পর ভ্রমে পড়িয়াছে। ভ্রমসংশোধন করিয়া দিবামাত্র তাহার ফল হাতে হাতে, অতএব সেখানে তর্ক করা এবং কার্য করা একই।
আমাদের দেশে সে কথা খাটে না। কারণ, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, এবং আমরা কর্তা নহি। তার্কিক বলিয়া থাকেন, ‘সে কী কথা। আমরা যে বহুকোটি টাকা সরকারকে দিয়া থাকি, এই টাকার উপরেই যে সরকারের নির্ভর—আমাদের কর্তৃত্ব থাকিবে না কেন। আমরা এই টাকার হিসাব তলব করিব’। গোরু যে নন্দনন্দনকে দুই বেলা দুধ দেয়, সেই দুধ খাইয়া নন্দনন্দন যে বেশ পরিপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছেন, গোরু কেন শিং নাড়িয়া নন্দনন্দনের কাছ হইতে দুধের হিসাব তলব না করে! কেন যে না করে, তাহা গোরুর অন্তরাত্মাই জানে এবং তাহার অন্তর্যামীই জানেন।
সাদা কথা এই যে, অবস্থাভেদে উপায়ের বিভিন্নতা ঘটিয়া থাকে। মনে করো-না কেন, ফরাসি রাষ্ট্রের নিকট হইতে ইংরেজ যদি কোনো সুবিধা আদায়ের মতলব করে, তবে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে তর্কে নিরুত্তর করিবার চেষ্টা করে না, এমন-কি, তাহাকে ধর্মোপদেশও শোনায় না—তখন ফরাসি কর্তৃপক্ষের মন পাইবার জন্য তাহাকে নানাপ্রকার কৌশল অবলম্বন করিতে হয়—এইজন্যই কৌশলী রাজদূত নিয়তই ফ্রান্সে নিযুক্ত আছে। শুনা যায়, একদা জার্মানি যখন ইংলণ্ডের বন্ধু ছিল তখন ডিউক-উপাধিধারী ইংরেজ রাজদূত ভোজনসভায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া জার্মানরাজের হাতে তাঁহার হাত মুছিবার গামছা তুলিয়া দিয়াছেন। ইহাতে অনেক কাজ পাইয়াছিলেন। এমন একদিন ছিল যেদিন মোগল-সভায়, নবাবের দরবারে, ইংরেজের বহু তোষামোদ, বহু অর্থব্যয়, বহু গুপ্ত কৌশল অবলম্বন করিতে হইয়াছিল। সেদিন কত গায়ের জ্বালা যে তাঁহাদিগকে আশ্চর্য প্রসন্নতার সহিত গায়ে মিলাইতে হইয়াছিল, তাহার সীমাসংখ্যা নাই। পরের সঙ্গে সুযোগের ব্যবসায় করিতে গেলে ইহা অবশ্যম্ভাবী।
আর, আমাদের দেশে আমাদের মতো নিরুপায় জাতিকে যদি প্রবল পক্ষের নিকট হইতে কোনো সুযোগলাভের চেষ্টা করিতে হয়, তবে কি আন্দোলনের দ্বারাতেই তাহা সফল হইবে? যে দুধের মধ্যে মাখন আছে, সেই দুধে আন্দোলন করিলে মাখন উঠিয়া পড়ে; কিন্তু মাখনের দুধ রহিল গোয়াল-বাড়িতে, আর আমি আমার ঘরের জলে অহরহ আন্দোলন করিতে রহিলাম, ইহাতে কি মাখন জুটিবে? যাঁহারা পুঁথিপন্থী তাঁহারা বুক ফুলাইয়া বলিবেন—আমরা তো কোনোরূপ সুযোগ চাই না, আমরা ন্যায্য অধিকার চাই। আচ্ছা, সেই কথাই ভালো। মনে করো, তোমার সম্পত্তি যদি তামাদি হইয়া থাকে, তাহা হইলে ন্যায্য স্বত্বও যে দখলিকারের মন জোগাইয়া উদ্ধারের চেষ্টা করিতে হয়। গবর্মেন্ট বলিতে তো একটা লোহার কল বোঝায় না। তাহার পশ্চাতে যে রক্তমাংসের মানুষ আছেন—তাঁহারা যে ন্যূনাধিকপরিমাণে ষড়্রিপুর বশীভূত। তাঁহারা রাগদ্বেষের হাত এড়াইয়া একেবারে জীবন্মুক্ত হইয়া এ দেশে