প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
সর্বাপেক্ষা এইজন্যই বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে—নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থাভার নিজেরা গ্রহণ করা। তাহাতে আমাদের বিদ্যামন্দিরে কেম্ব্রিজ-অক্সফোর্ডের প্রকাণ্ড পাষাণ প্রতিরূপ প্রতিষ্ঠিত হইবে না জানি, তাহার সাজসরঞ্জাম দরিদ্রের উপযুক্ত হইবে, ধনীর চক্ষে তাহার অসম্পূর্ণতাও অনেক লক্ষিত হইবে—কিন্তু জাগ্রত সরস্বতী শ্রদ্ধাশতদলে আসীন হইবেন, তিনি জননীর মতো করিয়া সন্তানদিগকে অমৃত পরিবেশন করিবেন, ধনমদগর্বিতা বণিকগৃহিণীর মতো উচ্চ বাতায়নে দাঁড়াইয়া দূর হইতে ভিক্ষুকবিদায় করিবেন না।
পরের কাছ হইতে হৃদ্যতাবিহীন দান লইবার একটা মস্ত লাঞ্ছনা এই যে, গর্বিত দাতা খুব বড়ো করিয়া খরচের হিসাব রাখে, তাহার পরে দুই বেলা খোঁটা দেয়, ‘এত দিলাম, তত দিলাম, কিন্তু ফলে কী হইল?’ মা স্তন্যদান করেন, খাতায় তাহার কোনো হিসাব রাখেন না, ছেলেও বেশ পুষ্ট হয়—স্নেহবিহীনা ধাত্রী বাজার হইতে খাবার কিনিয়া রোরুদ্যমান মুখের মধ্যে গুঁজিয়া দেয়, তাহার পরে অহরহ খিট্খিট্ করিতে থাকে, ‘এত গিলাইতেছি, কিন্তু ছেলেটা দিন দিন কেবল কাঠি হইয়া যাইতেছে!’
আমাদের ইংরাজ কর্তৃপক্ষেরা সেই বুলি ধরিয়াছেন। পেড্লার সেদিন বলিয়াছেন, ‘আমরা বিজ্ঞানচর্চার এত বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম, এত আনুকূল্য করিলাম, বৃত্তির টাকার এত অপব্যয় করিতেছি, কিন্তু ছাত্রেরা স্বাধীনবুদ্ধির কোনো পরিচয় দিতেছে না!’
অনুগ্রহজীবীদিগকে এই-সব কথাই শুনিতে হয়, অথচ আমাদের বলিবার মুখ নাই—‘বন্দোবস্ত সমস্ত তোমাদেরই হাতে এবং সে বন্দোবস্তে যদি যথেষ্ট ফললাভ না হয় তাহার সমস্ত পাপ আমাদেরই!’ এ দিকে খাতায় টাকার অঙ্কটাও গ্রেট্প্রাইমার অক্ষরে দেখানো হইতেছে যেন এত বিপুল টাকা এতবড়ো প্রকাণ্ড অযোগ্যদের জন্য জগতে আর কোনো দাতাকর্ণ ব্যয় করে না, অতএব ইহার moral এই—‘হে অক্ষম, হে অকর্মণ্য, তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তোমরা রাজভক্ত হও, তোমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে চাঁদা দিতে কপোলযুগ পাণ্ডুবর্ণ করিয়ো না!’
ইহাতে বিদ্যালাভ কতটুকু হয় জানি না, কিন্তু আত্মসম্মান থাকে না। আত্মসম্মান ব্যতীত কোনো জাত কোনো সফলতা লাভ করিতে পারে না; পরের ঘরে জল তোলা এবং কাঠ কাটার কাজে লাগিতে পারে, কিন্তু দ্বিজধর্ম অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের বৃত্তিরক্ষা করিতে পারে না।
একটা কথা আমাদিগকে সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদিগকে যে খোঁটা দেওয়া হইয়া থাকে তাহা সম্পূর্ণ অমূলক। এবং যাঁহারা খোঁটা দেন তাঁহারাও যে মনে মনে তাহা জানেন না তাহাও আমরা স্বীকার করিব না। কারণ, আমরা দেখিয়াছি, পাছে তাঁহাদের কথা অপ্রমাণ হইয়া যায় এজন্য তাঁহারা ত্রস্ত আছেন।
এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে, বিলাতি সভ্যতা বস্তুত দুরূহ ও দুর্লভ নয়। স্বাধীন জাপান আজ পঞ্চাশ বৎসরে এই সভ্যতা আদায় করিয়া লইয়া গুরুমারা বিদ্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছে। এ সভ্যতা অনেকটা ইস্কুলের জিনিস; পরীক্ষা করা, মুখস্থ করা, চর্চা করার উপরেই ইহার নির্ভর। জাপানের মতো সম্পূর্ণ সুযোগ ও আনুকূল্য পাইলে এই ইস্কুল পাঠ আমরা পেড্লার সম্প্রদায় আসিবার বহুকাল পূর্বেই শেষ করিতে পারিতাম। প্রাচ্য সভ্যতা ধর্মগত, তাহার পথ নিশিত ক্ষুরধারের ন্যায় দুর্গম, তাহা ইস্কুলের পড়া নহে—তাহা জীবনের সাধনা।
এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে, এতকাল অনেক বিদেশী অধ্যাপক আমাদের কলেজের পরীক্ষাশালায় যন্ত্রতন্ত্র লইয়া