বাংলাভাষা-পরিচয় ১৪
ম’ল (মরল)। দুই অক্ষরের ক্রিয়াপদমাত্রে এই ব্যতিক্রম হয় এমন যেন মনে করা না হয়। তার প্রমাণ : খেল নিল দিল শুল ধুল। ইতে-প্রত্যয়যুক্ত জোড়া ক্রিয়াপদে ‘এ’ লাগে না, যেমন : করতে থাকল, হাসতে লাগল। কিন্তু ইয়া-প্রত্যয়যুক্ত জোড়া ক্রিয়াপদে লাগে, যেমন : সে হেসে ফেললে। এ ছাড়া আরও দুই-এক জায়গায় কানে সন্দেহ ঠেকে, যেমন : ‘ভোর বেলায় সে মরলে’ বলি নে, ‘মরল’ই ঠিক শোনায়। কিন্তু ‘তিনি মরলেন’ নিত্যব্যবহৃত। ‘কলকাতায় সে চললে’ বলি নে, কিন্তু ‘তিনি চললেন’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

প্রাচীন রামায়ণে দেখা গেছে প্রথমপুরুষের সদ্যঅতীত ক্রিয়াপদে প্রায় সর্বত্রই ক-প্রত্যয়-সমেত একার, যেমন : দিলেক লইলেক। আবার একারের সম্পর্ক নেই এমন দৃষ্টান্তও অনেক আছে, যেমন : চলিল সত্বর, পাঠাইল ত্বরিত। আধুনিক বাংলায় এইরূপ ক্রিয়াপদে কোথাও ‘এ’ লাগে কোথাও লাগে না, কিন্তু অন্তস্থিত ক-প্রত্যয়টা খসে গেছে।

প্রথমপুরুষ ইল-প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াপদে এই-যে একার প্রয়োগ, এরই সঙ্গে সম্ভবত ‘করলেম’ ‘চললেম’ শব্দের একার-উচ্চারণের যোগ আছে। করলেন (করিল তিনি), আর, করলেম (করিল আমি) : এক নিয়মে পাশাপাশি বসতে পারে। আরও একটা কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, সে হচ্ছে স্বরবিকারের নিয়ম। ই’র পর আ থাকলে দুইয়ে মিলে ‘এ’ হয় তার অনেক দৃষ্টান্ত মেলে। যেমন ‘ঈশান’ থেকে ‘ঈশেন’, ‘বিলাত’ থেকে ‘বিলেত’, ‘নিশান’ থেকে ‘নিশেন’।

এক কালে ‘মুই’ ভদ্র সমাজে ত্যাজ্য ছিল না। প্রাচীন রামায়ণে পাওয়া যায় ‘মুঞি নরপতি’। কর্মকারকে ‘মোকে’, কোথাও বা ‘মোখে’। বহুবচনে ‘মোরা’। আজ ‘মোরা’ রয়ে গেছে কাব্যলোকে। কবির কলমে ‘আমরা’ শব্দের চেয়ে ‘মোরা’ শব্দের চলন বেশি। প্রাচীন বাংলায় ‘আমরা’ ‘তোমরা’র পরিবর্তে ‘আমিসব’ ‘তুমিসব’ শব্দের ব্যবহার প্রায়ই দেখা গেছে।

আমি তুমি আপনি তিনি : ব্যক্তিবাচক সর্বনাম, মানুষ সম্বন্ধেই খাটে। ‘সে’ মেলমাত্র মানুষ নয় জন্তু সম্বন্ধেও খাটে, যেমন : কুকুরটাকে মারতেই সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘সে’ থেকে বিশেষণ শব্দ হয়েছে ‘সেই’। এর প্রয়োগ সর্বত্রই : সেই মানুষ, সেই গাছ, সেই গোরু। ‘এ’ থেকে হয়েছে ‘এই’। ‘এ’ বোঝায় কাছের বর্তমান পদার্থকে, ‘সে’ বোঝায় অবর্তমানকে। সম্মানার্থে ‘এ’ থেকে হয়েছে ‘ইনি’।

বাংলা ভাষার একটা বিশেষত্ব এই যে, সর্বনামে লিঙ্গভেদ নেই। ইংরেজিতে প্রথমপুরুষে এ he পুংলিঙ্গ, she স্ত্রীলিঙ্গ, it ক্লীবলিঙ্গ। ইংরেজিতে যদি বলতে হয়, সে পড়ে গেছে, তবে সেই প্রসঙ্গে he she বা it বলাই চাই। বাংলায় ক্লীবলিঙ্গের নির্দেশ আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গের নেই। সে এ ও তিনি ইনি উনি : স্ত্রীও হয়, পুরুষও হয়। ক্লীবলিঙ্গে ‘সে’ ‘এ’ ‘ও’ শব্দে নির্দেশক চিহ্ন যোগ করা চাই, যেমন : সেটা ওটা সেখানা ওখানা। বাংলা কাব্যে এই প্রথমপুরুষ সর্বনামে যখন ইচ্ছাপুর্বক লিঙ্গ নির্দেশ করা হয় না তখন ইংরেজি তর্জমা অসম্ভব হয়। ‘যে’ সর্বনাম পদের সঙ্গে কোনো না কোনো বিশেষ্য ঊহ্য বা ব্যক্ত রূপে থাকেই। ‘যে গান গাচ্ছে’ বলতে বোঝায়, যে মানুষ। অন্যত্র : যে ঘড়ি চলছে না, যে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

‘যেই’ শব্দের একটি প্রয়োগ আছে, তাতে ‘মুহূর্তে’ বা ‘ক্ষণে’ ঊহ্য থাকে, যথা : যেই এল অমনি চলে গেল, যেই দেখা সেই আর মুখে কথা নেই। এখানে ‘যেই আর সেই’ শব্দের পিছনে ঊহ্য আছে ‘ক্ষণে’। অন্যত্র ‘যেই’ বা ‘সেই’ শব্দের প্রয়োগে ঊহ্য থাকে ‘মানুষ’, যেমন : যেই আসুক সেই মার খাবে। ‘যাই’ শব্দের সঙ্গে ঊহ্য থাকে দুটি বিশেষণের দ্বন্দ্ব, যেমন : সে যাই বলুক। অর্থাৎ, এটাই বলুক বা ওটাই বলুক, ভালোই বলুক বা মন্দই বলুক। আর-এক প্রকার প্রয়োগ আছে ‘যেই কথা সেই কাজ’, অর্থাৎ কাজে কথায় প্রভেদ নেই—এখানে ই প্রত্যয় নিশ্চয়তা অর্থে ঝোঁক দেবার জন্যে।

‘যে’ অসম্পূর্ণার্থক সর্বনাম বিশেষণ, মানবার্থে তার পূরণ হয় ‘ও’ এবং ‘সে’ দিয়ে। অন্য জীব বা বস্তুর সম্বন্ধে যখন তার প্রয়োগ হয় তখন সেই বস্তু বা জীবের নাম তার সঙ্গে জুড়তে হয়, যেমন : যে পুকুর, যে ঘটি, যে বেড়াল। নির্বস্তুক শব্দে সেই