প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
এমনি করে অধিকাংশ মানুষই যখন বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এবং সমাজের মধ্যে মোটামুটি রকমে চলনসই হয়ে ওঠে তখনই তারা নিশ্চিন্ত হয়, এবং নিজেকে অনিন্দনীয় মনে করে খুশি হয়।
কিন্তু এমন টাকা আছে যা গাঁয়ে চলে কিন্তু শহরে চলে না শহরের বাজে দোকানে চলে যায় কিন্তু ব্যাঙ্কে চলে না। ব্যাঙ্কে তাকে ভাঙাতে গেলেই সেখানে যে পোদ্দারটি আছে সে একেবারে স্পর্শমাত্রেই তাকে তৎক্ষণাৎ মেকি বলে বাতিল করে দেয়।
আমাদেরও সেই দশা–আমরা ঘরের মধ্যে গাঁয়ের মধ্যে সমাজের মধ্যে নিজেকে চলনসই করে রেখেছি কিন্তু বড়ো ব্যাঙ্কে যখন দাঁড়াই তখনই পোদ্দারের কাছে একমুহূর্তে আমাদের সমস্ত খাদ ধরা পড়ে যায়।
সেখানে যদি চলতি হতে চাই তবে সত্য হতে হবে, আরও সত্য হতে হবে। আরও অনেক বাঁধনে নিজেকে বাঁধতে হবে, আরও অনেক দায় মানতে হবে। সেই অমৃতের বাজারে এতটুকু মেকিও চলে না–একেবার খাঁটি সত্য না হলে অমৃত কেনবার অশা করাও যায় না।
তাই বলছিলুম কেবল অমৃতরসের কথা তো বললেই হবে না, তার হিসাবটাও দেখতে হবে। আমরা নিজের হিসাব যখন মেলাতে বসি তখন দু-চার টাকার গরমিল হলেও বলি ওতে কিছু আসে যায় না। এমনি করে রোজই গরমিলের অংশ কেবলই জমে উঠেছে। প্রকৃতির সঙ্গে এবং মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে প্রত্যহই ছোটোবড়ো কত অসত্য কত অন্যায়ই চালিয়ে দিচ্ছি সে-সম্বন্ধে যদি কথা ওঠে তো বলে বসি অমন তো আক্সার হয়েই থাকে, অমন তো কত লোকেই করে–ওতে করে এমন ঘটে না যে আমি ভদ্রসমাজের বার হয়ে যাই।
ঘরো হিসাবের খাতায় এইরকম শৈথিল্য বটে কিন্তু যারা জাতিতে সাধু, যারা মহাজন, তারা লাখটাকার কারবারে এক পয়সার হিসবাটি না মিললে সমস্ত রাত্রি ঘুমোতে পারে না। যারা মস্ত লাভের দিকে তাকিয়ে আছে তারা ছোট্টো গরমিলকেও ডরায়–তারা হিসাবকে একেবারে নিখুঁত সত্য না করে বাঁচে না।
তাই বলছিলুম সেই যে পরম রস প্রেমরস–তার মহাজন যদি হতে চাই তবে হিসাবের খাতাকে নীরস বলে একটু ফাঁকি দিলেও চলবে না। যিনি অমৃতের ভাণ্ডারী তাঁর কাছে বেহিসাবি আবদার একেবারেই খাটবে না। তিনি যে মস্ত হিসাবি–এই প্রকাণ্ড জগদ্ব্যাপারে কোথাও হিসাবের গোল হয় না–তাঁর কাছে কোন্ লজ্জায় গিয়ে বলব, আমি আর কিছু জানি নে, আর কিছু মানি নে, আমাকে কেবল প্রেম দাও, আমাকে প্রেমে মাতাল করে তোলো।
আত্মা যেদিন অমৃতের জন্যে কেঁদে ওঠে তখন সর্বপ্রথমেই বলে–অসতো মা সদ্গময়–আমার জীবনকে আমার চিত্তকে সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল অসত্য হতে সত্যে বেঁধে ফেলো–অমৃতের কথা তার পরে।
আমাদেরও প্রতিদিন সেই প্রার্থনাই করতে হবে বলতে হবে, অসতো মা সদ্গময়–বন্ধনহীন অসংযত অসত্যের মধ্যে আমাদের মন হাজার টুকরো করে ছড়িয়ে ফেলতে দিয়ো না–তাকে অটুট সত্যের সূত্রে সম্পূর্ণ করে বেঁধে ফেলো–তার পরে সে হার তোমার গলায় যদি পরাত চাই তবে আমাকে লজ্জা পেতে হবে না।