য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি
আলোক ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দ্রুতপদে একবার দেখা দিচ্ছে একবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কোথাও বা পাঁচ-সাতজন স্ত্রীপুরুষ এবং জাহাজের কর্মচারী জটলা করে উচ্চহাস্যে প্রমোদকল্লোল উচ্ছ্বসিত করে তুলছে। অলস পুরুষেরা কেউ বা বসে কেউ বা দাঁড়িয়ে কেউ বা অর্ধশয়ান অবস্থায় চুরুট টানছে, কেউ বা স্মোকিং সেলুনে কেউ বা নিচে খাবার ঘরে হুইস্কি সোডা পাশে রেখে চারজনে দল বেঁধে বাজি রেখে তাস খেলছে। ওদিকে সংগীতশালায় সংগীতপ্রিয় দু-চারজনের সমাবেশ গানবাজনা এবং মাঝে মাঝে করতালি শোনা যাচ্ছে।

ক্রমে সাড়ে দশটা বাজে, মেয়েরা নেবে যায়, ডেকের উপরে আলো হঠাৎ যায় নিবে, ডেক নিঃশব্দ নির্জন অন্ধকার হয়ে আসে। চারিদিকে নিশীথের নিস্তব্ধতা, চন্দ্রালোক এবং অনন্ত সমুদ্রের অশ্রান্ত কলধ্বনি।

২৭ অক্টোবর। লোহিত সমুদ্রের গরম ক্রমেই বেড়ে উঠছে। ডেকের উপর মেয়েরা সমস্ত দিনে তৃষাতুরা হরিণীর মতো ক্লিষ্ট কাতর। তারা কেবল অতি ক্লান্তভাবে পাখা নাড়ছে, স্মেলিং সল্ট শুঁকছে, এবং সকরুণ যুবকেরা যখন পাশে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করছে তখন নিমীলিতপ্রায় নেত্রপল্লব ঈষৎ উন্মীলন করে ম্লানহাস্যে কেবল গ্রীবাভঙ্গী দ্বারা আপন সুকুমার দেহলতার একান্ত অবসন্নতা ইঙ্গিতে জানাচ্ছে। যতই পরিপূর্ণ করে টিফিন এবং লেবুর শরবৎ খাচ্ছে, ততই জড়ত্ব এবং ক্লান্তি বাড়ছে, নেত্র নিদ্রানত ও সর্বশরীর শিথিল হয়ে আসছে।

২৮ অক্টোবর। আজ এডেনে পৌঁছোনো গেল।

২ ক্টোবর। আমাদের জাহাজে একটি পার্সি সহযাত্রী আছে। তার ছুঁচোলো ছাঁটা দাড়ি এবং বড়ো বড়ো চোখ সর্বপ্রথমেই চোখে পড়ে। অল্প বয়স। নয় মাস য়ুরোপে বেড়িয়ে বিলিতি পোশাক এবং চালচলন ধরেছে। বলে, ইণ্ডিয়া লাইক করে না। বলে, তার য়ুরোপীয় বন্ধুদের (অধিকাংশ স্ত্রীবন্ধু) কাছ থেকে তিন-শ চিঠি এসে তার কাছে জমেছে, তাই নিয়ে বেচারা মহা মুশকিলে পড়েছে, কখনই বা পড়বে কখনই বা জবাব দেবে। লোকটা আবার নিজে বন্ধুত্ব করতে বড়োই নারাজ, কিন্তু বিধাতার বিড়ম্বনায় বন্ধুত্ব তার মাথার উপরে অনাহূত অযাচিত বর্ষিত হতে থাকে। সে বলে, বন্ধুত্ব করে কোনো ‘ফান্‌’ নেই। উপরন্তু কেবল ল্যাঠা। এমন কি শত শত জার্মান ফরাসি ইটালিয়ান এবং ইংরেজ মেয়ের সঙ্গে সে ‘ফ্লার্ট’ করে এসেছে কিন্তু তাতে কোনো মজা পায় নি।

২ নভেম্বর। ভারতবর্ষের কাছাকাছি আসা গেছে। কাল বোম্বাই পৌঁছবার কথা। আজ সুন্দর সকালবেলা। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সমুদ্র সফেন তরঙ্গে নৃত্য করছে, উজ্জ্বল রৌদ্র উঠেছে; কেউ ক্বয়েট্‌স্‌ খেলছে, কেউ নভেল পড়ছে, কেউ গল্প করছে; ম্যুজিক সেলুনে গান, স্মোকিং সেলুনে তাস, ডাইনিং সেলুনে খানার আয়োজন হচ্ছে এবং একটি সংকীর্ণ ক্যাবিনের মধ্যে আমাদের একটি বৃদ্ধ সহযাত্রী মরছে।

সন্ধ্যা আটটার সময় ডিলন সাহেবের মৃত্যু হল। আজ সন্ধ্যার সময় একটি নাটক অভিনয় হবার কথা ছিল।

৩ নভেম্বর। সকালে অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠানের পর ডিলনের মৃতদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হল। আজ আমাদের সমুদ্রযাত্রার শেষ দিন।

অনেক রাত্রে জাহাজ বোম্বাই বন্দরে পৌঁছল।

৪ নভেম্বর। জাহাজ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে নেমে এখন আমার অদৃষ্টের সঙ্গে আর কোনো মনান্তর নেই। সংসারটা মোটের উপরে বেশ আনন্দের স্থান বোধ হচ্ছে। কেবল একটা গোল বেধেছিল—টাকাকড়ি সমেত আমার ব্যাগটি জাহাজের ক্যাবিনে ফেলে এসেছিলুম, তাতে করে সংসারের আবহাওয়ার হঠাৎ অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হোটেল থেকে অবিলম্বে জাহাজে ফিরে গিয়ে সেটি সংগ্রহ করে এনেছি। এই ব্যাগ ভুলে যাবার সম্ভাবনা কাল চকিতের মতো একবার মনে উদয় হয়েছিল। মনকে তখনই সাবধান করে দিলুম, ব্যাগটি যেন না ভোলা হয়। মন বললে, ক্ষেপেছ! আজ সকালে তাকে বৃথা ভর্ৎসনা করেছি। নষ্টোদ্ধার করে হোটেলে ফিরে এসে স্নানের পর আরাম বোধ হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে আমার বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি কটাক্ষপাত করবেন সৌভাগ্যক্রমে এমন