সংগীতের মুক্তি

উদাস মোর প্রাণপাখি।
কখন্‌ তার রথ আসে
ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি।

এও তো আর-এক ছন্দ। ইহার লয় পাঁচে চারে মিলিয়া। আবার এইটেকে উলটাইয়া দিয়া চারে পাঁচে করিলে ন’য়ের ছন্দকে লইয়া নয়-ছয় করা যাইতে পারে। চৌতাল তো বারো মাত্রার ছন্দ। কিন্তু এই বারো মাত্রা রক্ষা করিলেও চৌতালকে রক্ষা করা যায় না এমন হয়। এই তো বারো মাত্রা–

বনের পথে পথে বাজিছে বায়ে
নূপুর রুনুরুনু কাহার পায়ে।
কাটিয়া যায় বেলা মনের ভুলে,
বাতাস উদাসিছে আকুল চুলে–
ভ্রমরমুখরিত বকুল-ছায়ে
নূপুর রুনুরুনু কাহার পায়ে!

ইহা চৌতালও নহে, একতালও নহে, ধামারও নয় ঝাঁপতালও নয়। লয়ের হিসাব দিলেও, তালের হিসাব মেলে না। তালওয়ালা সেই গরমিল লইয়া কবিকে দায়িক করে।

কিন্তু হাল আমলে এ-সমস্ত উৎপাত চলিবে না। আমরা শাসন মানিব, তাই বলিয়া অত্যাচার মানিব না। কেননা, যে নিয়ম সত্য সে নিয়ম বাহিরের জিনিস নয়, তাহা বিশ্বের বলিয়াই তাহা আমার আপনার। যে নিয়মওস্তাদের তাহা আমার ভিতরে নাই, বাহিরে আছে, সুতরাং তাকে অভ্যাস করিয়া বা ভয় করিয়া বা দায়ে পড়িয়া মানিতে হয়। এইরূপ মানার দ্বারাই শক্তির বিকাশ বন্ধ হইয়া যায়। আমাদের সংগীতকে এই মানা হইতে মুক্তি দিলে তবেই তার স্বভাব তার স্বরূপকে নব নব উদ্‌ভাবনার ভিতর দিয়া ব্যক্ত করিতে থাকিবে।

এই তো গেল সংগীতের আভ্যন্তরিক উপদ্রব। আবার বাহিরে একদল বলবান লোক আছেন, তাঁরা সংগীতকে দ্বীপান্তরে চালান করিতে পারিলে সুস্থ থাকেন। শ্যামের বাঁশির উপর রাগ করিয়া রাধিকা যেমন বাঁশবনটাকে একেবারে ঝাড়ে-মূলে উপাড়িতে চাহিয়াছিলেন ইহাদের সেইরকম ভাব। মাটির উপর পড়িলে গায়ে ধুলা লাগে বলিয়া পৃথিবীটাকে বরখাস্ত করিতে ইহারা কখনোই সাহস করেন না, কিন্তু গানকে ইঁহারা বর্জন করিবার প্রস্তাব করেন এই সাহসে যে, তাঁরা মনে করেন গানটা বাহুল্য, ওটা না হইলেও কাজ চলে এবং পেট ভরে। এটা বোঝেন না যে, বাহুল্য লইয়াই মনুষ্যত্ব, বাহুল্যই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য। সত্যের পরিণাম সত্য নহে, আনন্দে। আনন্দ সত্যের সেই অসীম বাহুল্য যাহাতে আত্মা আপনাকেই আপনি প্রকাশ করে–কেবল আপনার উপকরণকে নয়। যদি কোনো সভ্যতার বিচার করিতে হয় তবে এই বাহুল্য দিয়াই তার পরিমাপ। কেজো লোকেরা সঞ্চয় করে। সঞ্চয়ে প্রকাশ নাই, কেননা প্রকাশ ত্যাগে। সেই ত্যাগের সম্পদই বাহুল্য।

সঞ্চয় করাও নহে, ভোগ করাও নহে, কিন্তু আপনাকে প্রকাশ করিবার যে প্রেরণা তাহাতেই আপনার বিকাশ। গান যদি কেবল বৈঠকখানার ভোগবিলাস হয়, তবে তাহাতে নির্জীবতা প্রমাণ করে। প্রকাশের যত রকম ভাষা আছে সমস্তই মানুষের হাতে দিতে হইবে। কেননা, যে পরিমাণে মানুষ বোবা সেই পরিমাণে সে দুর্বল, সে অসম্পূর্ণ। এইজন্য ওস্তাদের গড়খাই-করা গানকে আমাদের সকলের করা চাই। তাহা হইলে জীবনের ক্ষেত্রে গানও বড়ো হইবে, সেই গানের সম্পদে জীবনও বড়ো হইবে।

এতদিন আমাদের ভদ্রসমাজ গানকে ভয় করিয়া আসিতেছিল। তার কারণ, যা সকলের জিনিস, ভোগী তাকে বাঁধ দিয়া