সংযোজন
কিন্তু একেবারেই ঠাই বজায় না রাখি যদি তবে সেটা পাগলামি হয়ে দাঁড়ায়। শিশুকালে শিশুবোধে দেখেছি প্রেয়সীকে পত্র লেখবার বিশেষ পাঠ ও রীতি বেঁধে দেওয়া ছিল, সেটাতে তখনকার কালের প্রবীণদের সম্মতি ছিল সন্দেহ নেই। তর্কের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাক, প্রেমলিপি লেখবার সেই ছাঁদ যথার্থই অত্যন্ত মনোহর–কিন্তু, কালান্তর ঘটতেই, অর্থাৎ যৌবনকাল উপস্থিত হতেই দেখা যায় সে ভাষায় কোনো পক্ষের মেজাজ সায় দেয় না। তখন স্বতই যে ভাষা দেখা দেয় তার মধ্যে পিতৃপিতামহদের অনুমোদিত ধ্রুবনির্দিষ্ট শব্দলালিত্য ও রচনানৈপুণ্য না থাকতে পারে, ব্যাকরণের বিশেষত বানানের ভুলচুক থাকাও অসম্ভব নয়, দুটো-একটা ইংরেজি শব্দও তার মধ্যে হয়তো অগত্যা ঢুকে পড়ে, কিন্তু শুচিবায়ুগ্রস্ত মুরব্বিরা যাই বলুন-না কেন তার মধ্যে যে সহজ রসসঞ্চার হয় তাকে অবজ্ঞা করা চলবে না। সেই মুরুব্বিরাই যদি ষোড়শী চতুর্থপক্ষীয়ার দিকে দুর্নিবার ধাক্কায় ঝুঁকে পড়েন, তবে হঠাৎ দেখা যাবে তাঁদের ভাষাও শিকল ছিঁড়েছে। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও মূল ভাষাটা বাংলা, সেখানে সেকাল একালের নাড়ীর যোগ। এই ভাষা বহু শতাব্দীর বহু নরনারীর বিচিত্র ভাবনা কামনা ও বেদনার নিরন্তর অভিঘাতে বিশেষভাবে প্রাণময় চিন্ময় দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে, বিশেষভাবে বাঙালির চিন্তা ও ইচ্ছাকে রূপ দেবার জন্যেই তার সৃষ্টি। এইজন্যে, কোনো বাঙালির যতই প্রতিভার জোর থাক্‌, বিদেশী ভাষার ভূমিতে সাহিত্যের কীর্তিস্তম্ভ সে স্থায়ীভাবে গড়ে তুলতে পারে না। আমাদের বাংলা ভাষায় রূপ বদল হচ্ছে নিয়তই, বদল হতে যে পারে তার মহৎ গুণ–কিন্তু, সমস্ত বদল হবে তার আদি প্রকৃতির উপর ভর দিয়ে।

গান সম্বন্ধেও এই কথাই খাটে। ভারতবর্ষের বহু-যুগের-সৃষ্টি-করা যে সংগীতের মহাদেশ, তাকে অস্বীকার করলে দাঁড়াব কোথায়? পশ্চিম মহাদেশেও বাসযোগ্য স্থান নিশ্চিত আছে, কিন্তু সেখানে ভাড়াটে বাড়ির ভাড়া জোগাব কোথা থেকে? বাংলাদেশে আমার নামে অনেক প্রবাদ প্রচলিত; তারই অন্তর্গত একটি জনশ্রুতি আছে যে, আমি হিন্দুস্থানী গান জানি নে, বুঝি নে। আমার আদিযুগের রচিত গানে হিন্দুস্থানী ধ্রুবপদ্ধতির রাগরাগিণীর সাক্ষী-দল অতি বিশুদ্ধ প্রমাণ সহ দূর ভাবীশতাব্দীর প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিদারুণ বাদবিতণ্ডার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। ইচ্ছা করলেও সংগীতকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি নে; সেই সংগীত থেকেই আমি প্রেরণা লাভ করি এ কথা যারা জানে না তারাই হিন্দুস্থানী সংগীত জানে না। হিন্দুস্থানী গানকে আচারের শিকলে যাঁরা অচল করে বেঁধেছেন, সেই ডিক্‌টেটারদের আমি মানি নে। যাঁরা বলেন ভারতীয় গানের বিরাট ভূমিকার উপরে নব নব যুগের নব নব যে সৃষ্টি স্বপ্রকাশ তার স্থান নেই –ঐখানে হাতকড়ি-পরা বন্দীদের পুনঃ পুনঃ আবর্তনের অনতিক্রমণীয় চক্রপথ আছে মাত্র এমনতর নিন্দোক্তি যাঁরা স্পর্ধা-সহকারে ঘোষণা করে থাকেন তাঁদেরই প্রতিবাদ করবার জন্যই আমার মতো বিদ্রোহীদের জন্ম–সেই প্রতিবাদ ভিন্ন প্রণালীতে কীর্তনকাররাও করে গেছেন। ইতি ৭ই জানুয়ারি

তোমাদের

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

কল্যাণীয় ধূর্জটি,

কাল পর্যন্ত গেল বসন্ত-উৎসবের আয়োজন। আগামী কাল চলেছি কলকাতায়। এরই মাঝখানে এক-টুকরো অবকাশ–সংক্ষেপে সারতে হবে তোমার ফরমাশ। তোমাদের ওখানে গানের মজলিশে ছায়ানট গাওয়া হয়েছিল। ঘড়ি দেখি নি, কিন্তু অন্তরে যে ঘড়িটা রক্তের দোলায় চলে তাতে মনে হল এক ঘণ্টা পেরোলো বা। ছায়ানটের যত রূপারূপান্তর আছে, তানকর্তব সারেগম, যত রকম লয়ে-বিলয়ে তাকে উল্‌টানো পাল্‌টানো যেতে পারে, তার কিছুই বাদ পড়ে নি। আমার অভিমত কী জানতে চাও–সময় খারাপ, বলতে সাহস করি নে। তোমাদের মেজাজ ভালো নয়। মতবিরোধ নিয়ে তোমরা যাকে যুক্তি বলো আমরা তাকে বলি গাল–ঘাঁটাতে ভয় করি। তা হোক, গীত-আলোচনায় যদি তোমার কানের সঙ্গে আমার কানের প্রভেদ দেখতে পাও তা হলে এই ব’লে তার