প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
মহা উৎসাহে লাফ দিয়ে উঠে সে চীৎকারস্বরে বললে, প্রমাণ হয়েছে!
কিসের প্রমাণ।
বেসুরের দুঃসহ জোর। একেবারে ডাইনামাইট। বদ্সুরের ভিতর থেকে ছাড়া পেয়েছে দুর্জয় বেগ, উড়ে গিয়েছে পাড়ার ঘুম, দৌড় দিয়েছে পাড়ার শান্তি, পালাই - পালাই রব উঠেছে চার দিকে। প্রচণ্ড আসুরিক শক্তি। এর ধাক্কা একদিন টের পেয়েছিলেন স্বর্গের ভালো - মানুষরা। বসে বসে আধ চোখ বুজে অমৃত খাচ্ছিলেন। গন্ধর্ব ওস্তাদের তম্বুরা ঘাড়ে অতি নিখুঁত স্বরে তান লাগাচ্ছিলেন পরজ - বসন্তে, আর নূপুরঝংকারিণী অপ্সরীরা নিপুণ তালে তেহাই দিয়ে নৃত্য জমিয়েছিলেন। এ দিকে মৃত্যুবরণ নীল অন্ধকারে তিন যুগ ধরে অসুরের দল রসাতল - কোঠায় তিমিমাছের লেজের ঝাপ্টায় বেলয়ে বেসুর সাধনা করছিল। অবশেষে একদিন শনিতে কলিতে মিলে দিলে সিগ্নাল, এসে পড়ল বেসুর - সংগতের কালাপাহাড়ের দল সুরওয়ালাদের সমে - নাড়া - দেওয়া ঘাড়ে হুংকার ক্রেংকার ঝন্ঝন্কার ধ্রুম্কার দুড়ুমকার গড় - গড়্গড়ৎকার শব্দে। তীব্র বেসুরের তেলেবেগুনি জ্বলনে পিতামহ - পিতামহ ডাক ছেড়ে তাঁরা লুকোলেন ব্রহ্মাণীর অন্দরমহলে। তোমাকে বলব কী আর, তোমার তো জানা আছে সকল শাস্ত্রই।
জানা যে নেই আজ তা বোঝা গেল তোমার কথা শুনে।
দাদা, তোমাদের বই - পড়া বিদ্যে, আসল খবর কানে পৌঁছয় না। আমি ঘুরে বেড়াই শ্মশানে মশানে, গূঢ়তত্ত্ব পাই সাধকদের কাছ থেকে। আমার উৎকটদন্তী গুরুর মুখকন্দর থেকে বেসুরতত্ত্ব অল্প কিছু জেনেছিলুম, তাঁর পায়ে অনেকদিন ভেরেণ্ডার বিরেচক তৈল মর্দন ক'রে।
বেসুরতত্ত্ব আয়ত্ত করতে তোমার বিলম্ব হয় নি সেটা বুঝতে পারছি। অধিকারভেদ মানি আমি।
দাদা, ঐ তো আমার গর্বের কথা। পুরুষ হয়ে জন্মালেই পুরুষ হয় না, পরুষতার প্রতিভা থাকা চাই। একদিন আমার গুরুর অতি অপূর্ব বিশ্রীমুখ থেকে —
গুরুমুখকে আমরা বলে থাকি শ্রীমুখ, তুমি বললে বিশ্রীমুখ!
গুরুর আদেশ। তিনি বলেন, শ্রীমুখটা নিতান্ত মেয়েলি, বিশ্রী মুখই পুরুষের গৌরব। ওর জোরটা আকর্ষণের নয়, বিপ্রকর্ষণের। মান কি না।
মানতে যে হতভাগ্য বাধ্য হয় সে মানে বই কি।
মধুর রসে তোমার মৌতাত পাকা হয়ে গেছে দাদা, কঠোর সত্য মুখে রোচে না, ভাঙতে হবে তোমাদের দুর্বলতা — মিঠে সুরে যার নাম দিয়েছ সুরুচি, বিশ্রীকে সহ্য করবার শক্তি নেই যার।
দুর্বলতা ভাঙা সবলতা ভাঙার চেয়ে অনেক শক্ত। বিশ্রীতত্ত্বর গুরুবাক্য শোনাতে চাচ্ছিলে, শুনিয়ে দাও।
একেবারে আদিপর্ব থেকে গুরু আরম্ভ করলেন ব্যাখ্যান। বললেন, মানবসৃষ্টির শুরুতে চতুর্মুখ তাঁর সামনের দিকের দাড়ি - কামানো দুটো মুখ থেকে মিহি সুর বের করলেন। কোমল রেখাব থেকে মধুর ধারার মসৃণ মিড়ের উপর দিয়ে পিছলে গড়িয়ে এল কোমল নিখাদ পর্যন্ত। সেই সুকুমার স্বরলহরী প্রত্যুষের অরুণবর্ণ মেঘের থেকে প্রতিফলিত হয়ে অত্যন্ত আরামের দোলা লাগালো অতিশয় মিঠে হাওয়ায়। তারই মৃদু হিল্লোল দোলায়িত নৃত্যচ্ছন্দে রূপ নিয়ে দেখা দিল নারী। স্বর্গে শাঁখ বাজাতে লাগলেন বরুণদেবের ঘরনী।
বরুণদেবের ঘরনী কেন।