নারিকেল
সমুদ্রের ধারের জমিতেই নারিকেলের সহজ আবাস। আমাদের
আশ্রমের মাঠ সেই সমুদ্রকূল থেকে বহুদূরে। এখানে অনেক যত্নে
একটি নারিকেলকে পালন করে তোলা হয়েছে— সে নিঃসঙ্গ নিষ্ফল নিস্তেজ।
তাকে দেখে মনে হয় সে যেন প্রাণপণে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে দিগন্ত
অতিক্রম করে কোনো-এক আকাঙ্খার ধনকে দেখবার চেষ্টা করছে।
নির্বাসিত তরুর মজ্জার মধ্যে সেই আকাঙ্খা। এখানে আলোনা মাটিতে
সমুদ্রের স্পর্শমাত্র নেই, গাছের শিকড় তার বাঞ্ছিত রস এখানে সন্ধান করছে
, পাচ্ছে না ; সে উপবাসী, ধরণীর কাছে তার কান্নার সাড়া মিলছে না।
আকাশে উদ্যত হয়ে উঠে তার যে সন্ধানদৃষ্টিকে সে দিগন্তপারে
পাঠাচ্ছে দিনান্তে সন্ধ্যাবেলায় সেই তার সন্ধানেরই সজীব মূর্তির মতো পাখি
তার দোদুল্যমান শাখায় প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসে।
আজ বসন্তে প্রথম কোকিল ডেকে উঠল। দক্ষিণ হাওয়ায় আজ
কি সমুদ্রের বাণী এসে পৌঁছল, যে বাণী সমুদ্রের কূলে কূলে বধির মাটির
সুপ্তিকে নিয়তই অশান্ত তরঙ্গমন্ত্রে আন্দোলিত করে তুলেছে। তাই
কি আজ সেই দক্ষিণসমুদ্র থেকে তার তান্ডবনৃত্যের স্পর্শ এই গাছের শাখায়
শাখায় চঞ্চল। সমুদ্রের রুদ্রডমরুর জাগরণী কি এরই পল্লবমর্মরে
তার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি জাগিয়েছে। বিরহী তরু কি আজ আপন অন্তরে
সেই সুদূরবন্ধুর বার্তা পেল, যে বন্ধুর মহাগানে অভিনন্দিত হয়ে কোন্ অতীত
যুগে একদিন কোনো প্রথম নারিকেল প্রাণযাত্রীরূপে জীবলোকে যাত্রা শুরু
করেছিল? সেই যুগারম্ভপ্রভাতের আদিম উৎসবে মহাপ্রাণের যে
স্পর্শপুলক জেগেছিল তাই আজ ফিরে পেয়ে কি ঐ গাছটির সংবৎসরের অবসাদ আজ
বসন্তে ঘুচল। তার জীবনের জয়পতাকা আবার আজ কি ঐ নব উৎসাহে
নীলাম্বরে আন্দোলিত। যেন একটা আচ্ছাদন উঠে গেল, তার মজ্জার
মধ্যে প্রাণশক্তির যে আশ্বাসবাণী প্রচ্ছন্ন হয়েছিল তাকেই আজ কি ফিরে পেলে
, যে বাণী বলছে — ‘ চলো প্রাণতীর্থে, জয় করো মৃত্যুকে। '
সমুদ্রের কূল হতে বহুদূরে শব্দহীন মাঠে
নিঃসঙ্গ প্রবাস তব, নারিকেল — দিনরাত্রি কাটে
যে-প্রচ্ছন্ন আকাঙ্খায় বুঝিতে পার না তাহা নিজে।
দিগন্তেরে অতিক্রমি দেখিতে চাহিছ তুমি কী-যে
দীর্ঘ করি দেহ তব, মজ্জায় রয়েছে তার স্মৃতি
গূঢ় হয়ে। মাটির গভীরে যে রস খুঁজিছ নিতি
কী স্বাদ পাও না তাহে, অন্নে তার কী অভাব আছে,
তাই তো শিকড় উপবাসী, কাঁদে ধরণীর কাছে।
আকাশে রয়েছ চেয়ে রাত্রিদিন কিসের প্রত্যাশে
বাক্যহারা! বারবার শূন্য হতে ফিরে ফিরে আসে
তোমারি সন্ধানরূপী সন্ধ্যাবেলাকার শ্রান্ত পাখি
লম্বিত শাখায় তব।
ওই শুন উঠিয়াছে ডাকি
বসন্তের প্রথম কোকিল। সে বাণী কি এল প্রাণে
দক্ষিণপবন হতে, যে বাণী সমুদ্র শুধু জানে ;
পৃথিবীর কূলে কূলে যে বাণী গম্ভীর আন্দোলনে