প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
১৭
সেখানে আমরা এক সপ্তাহ কাটাইলাম, একদিন ঘোড়ায় চড়িয়া সিন্ধ্ উপত্যকার মুখে অবস্থিত গান্ধর্ব্বল দেখিতে বাহির হইলাম। সরোবরের পার্শ্ব বাহিয়া উচ্চ ভূমির উপরে ঘোড়া ছুটাইবার জন্য একটি অতি সুন্দর খোলা জায়গা দেখিতে পাইলাম –এমন সুযোগ ছাড়িবার নয়। উলার সরোবর আমাদের তৎপরবর্ত্তী লক্ষ্য ছিল; এইটি সকল সরোবরের চেয়ে বড়ো, সভ্যদেশ হইতে সকলের চেয়ে দূরে অবস্থিত। এই সঙ্গে এখানে এই কথাটিও জুড়িয়া দিই যে, ময়দা সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিলাম বলিয়া এবং নিজেদের রুটি নিজেরা তৈয়ারি করিয়াছিলাম বলিয়া দেখা গেল আমাদের অধিক সুবিধা হইয়াছে। দুগ্ধসম্বন্ধে আমরা গ্রামগুলির উপরে নির্ভর করিয়াছিলাম।
১৮
প্রত্যূষে আমরা মানসবল সরোবর ছাড়িলাম এবং সম্বল গ্রামে ঘোড়ায় চড়িয়া যাওয়াই পছন্দ করিয়া নৌকাগুলিকে আমাদের অনুসরণ করিতে বলিলাম। বৃহৎ সম্বল সেতুটির উপর দিয়া আমরা নদী পার হইলাম এবং ঘোড়ায় চড়িয়া তীর বাহিয়া আশামের দিকে চলিলাম ও সেইখানেই আমরা নৌকায় চড়িলাম। এখানে স্রোত প্রখর এবং আমরা অনায়াসেই ভাসিতে ভাসিতে সন্ধ্যা নাগাদই বন্যারে আসিলাম। উলার সরোবর পার হওয়া সে এক ব্যাপার; কারণ কাশ্মীরী মাল্লারা অনেক প্রকারের ভয়ে ও অন্ধসংস্কারে পূর্ণ। ঝড়ের ভয়ে তাহারা মধ্যাহ্নে ও অন্ধকারের ভয়ে সন্ধ্যার সময়ে পার হইবে না; একমাত্র ভোরে নির্বাত সময়ে যাইতে সম্মত হয়। প্রায় আড়াই ঘন্টায় পার হইয়া আমরা কুইনকুশে আসিলাম, ইহা হরিমঞ্জের ছায়াতলে সরোবরতীরবর্ত্তী একটি ক্ষুদ্র গ্রাম; এই হরিমঞ্জ পর্ব্বতটি সরোবরের পার্শ্বদেশ হইতে খাড়া উঠিয়াছে এবং উহার শীর্ষদেশে কোনো ফকিরের মন্দির মুকুটের ন্যায় বিরাজ করিতেছে।
১৯
গত মাস আমার পক্ষে যেমন দুঃখদায়ক হইয়াছিল, এমন আর কোনো কালে হয় নাই। বস্তুত কাতর হওয়া যে কাহাকে বলে ইহার পূর্ব্বে কখনো জানিতাম না। জানুয়ারির গোড়ার দিকে ইংলণ্ড হইতে পত্রযোগে আমার কনিষ্ঠ ভগিনীর মৃত্যু-সংবাদ আসে। সে যে আমার কী ছিল, তাহা কোনো বাক্য প্রকাশ করিতে পারে না। আমি এ কথা বলিব না যে, জগতের যে কোন পদার্থের চেয়ে সে আমার প্রিয় ছিল; কারণ যে ভগিনী আমার সঙ্গে ছিল সে তাহার সমতুল্য প্রিয়; কিন্তু এক মানুষ আর এক মানুষের যত প্রিয় হইতে পারে সে আমার তাহাই ছিল। এমন কি মহাকাল যদিও বেদনামোচনের কার্য্য আরম্ভ করিয়াছে, তথাপি এখনো তাহার কথা বলিতে গেলে একেবারে অপুরুষোচিতভাবে বিচলিত না হইয়া থাকিতে পারি না। আমি যে এই আঘাতের ব্যথায় সম্পূর্ণ তলাইয়া যাই নাই, সে জন্য প্রধানত সাহিত্যের কাছে আমি ঋণী।
২০
পর্ব্বতের চূড়া, সমুদ্র এবং মেরুপ্রদেশীয় তুষারক্ষেত্রের উপরিভাগের বায়ুমণ্ডল সর্ব্বত্রই ধূলিভারাক্রান্ত। অণুবীক্ষণযন্ত্রে প্রকাশ পায় যে, পুষ্পের পরাগ, উদ্ভিদ্তন্তুর অংশ, লোম, ধাতু ও প্রস্তরের কণা, জীবাণু ও রোগবীজের দ্বারা বায়ুমণ্ডলস্থ ধূলিরাশি গঠিত। বাতাসের ধূলিকণাসকল ছায়াশূন্য স্থানে আলোক প্রতিফলিত করে; এইগুলি না থাকিলে সমস্ত ছায়াময় স্থান কৃষ্ণবর্ণ হইত। ধূলিকণা অব্যবহিত সূর্য্যালোকের প্রখরতা হ্রাস করে, কারণ তাহা না থাকিলে, কৃষ্ণবর্ণ আকাশে সূর্য্য দুর্দ্দর্শতর উজ্জ্বলতা লাভ করিত এবং সেই আকাশে দিবাভাগেও নক্ষত্রেরা দৃশ্যমান হইত। আকাশের নীলিমা এবং সূর্য্যাস্ত-সূর্য্যোদয়-কালীন মহাপ্রভ বর্ণসমূহের হেতু তাহারাই ঐ ধূলিকণাকে বায়ুমধ্যস্থ জলীয় বাষ্প আবৃত করে, তাহার সংহতি মেঘ উৎপাদন করে ও তাহা হইতে বৃষ্টি হয়। অতএব বৃষ্টি-উৎপাদন সম্বন্ধে ধূলি অবশ্য-প্রয়োজনীয় না হইলেও, একটি প্রধান উপাদান বটে।