শেষ কথা
কিন্তু বাঙালি মেয়ে এই যেন প্রথম দেখলুম, ঠিক যে-জায়গায় তাকে সম্পূর্ণ দেখা যেতে পারে, এই নিভৃত বনের মধ্যে সে নানা পরিচিত-অপরিচিতের বাস্তবের সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে নেই; দেখে মনে হয় না, সে বেণী দুলিয়ে ডায়োসিশনে পড়তে যায়, কিংবা বেথুন কলেজের ডিগ্রিধারিণী, কিংবা বালিগঞ্জের টেনিসপার্টিতে উচ্চ কলহাস্যে চা পরিবেশন করে। অনেকদিন আগে ছেলেবেলায় হরু ঠাকুর কিংবা রাম বসুর যে গান শুনে তার পরে ভুলে গিয়েছিলুম, যে-গান আজ রেডিয়োতে বাজে না, গ্রামোফোনে পাড়া মুখরিত করে না, জানি নে কেন মনে হল সেই গানের সহজ রাগিণীতে ঐ বাঙালি মেয়েটির রূপের ভূমিকা— মনে রইল সই মনের বেদনা। এই গানের সুরে যে-একটি করুণ ছবি আছে, সে আজ রূপ নিয়ে আমার চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠল। এও সম্ভব হল। কোন্‌ প্রবল ভূমিকম্পে পৃথিবীর-যে তলায় লুকোনো আগ্নেয় সামগ্রী উপরে উঠে পড়ে, জিয়লজি শাস্ত্রে তা পড়েছি, নিজের মধ্যে দেখলুম সেই নীচের তলায় অন্ধকারের তপ্তবিগলিত জিনিসকে হঠাৎ উপরের আলোতে। কঠোর বিজ্ঞানী নবীনমাধবের অটল অন্তঃস্তরে এই উলটপালট আমি কোনোদিন আশা করতে পারি নি।

বুঝতে পারছি, যখন আমি রোজ বিকেলবেলায় এই পথ দিয়ে আমার কাজে ফিরেছি, ও আমাকে দেখেছে, অন্যমনস্ক আমি ওকে দেখি নি। বিলেতে যাবার পর থেকে নিজের চেহারার উপর একটা গর্ব জন্মেছে। ও, হাউ হ্যাণ্ডসম— এই প্রশস্তি কানাকানিতে আমার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিলেতফেরত আমার কোনো কোনো বন্ধুর কাছে শুনেছি, বাঙালি মেয়ের রুচি আলাদা, তারা মোলায়েম মেয়েলি রূপই পুরুষের রূপে খোঁজে। চলিত কথা হচ্ছে— কার্তিকের মতো চেহারা। বাঙালি কার্তিক আর যাই হোক, কোনো পুরুষে দেবসেনাপতি নয়। প্যারিসে একজন বান্ধবীর মুখে শুনেছি, বিলিতি সাদা রঙ রঙের অভাব; ওরিয়েন্টালের দেহে গরম আকাশ যে রঙ এঁকে দেয় সে সত্যিকার রঙ, সে ছায়ার রঙ, ঐ রঙই আমাদের ভালো লাগে; এ কথাটা বঙ্গোপসাগরের ধারে বোধ হয় খাটে না। এতদিন এ-সব আলোচনা আমার মনেই ওঠে নি। কয়েকদিন ধরে আমাকে ভাবিয়েছে। রোদে-পোড়া আমার রঙ, লম্বা আমার প্রাণসার দেহ, শক্ত আমার বাহু, দ্রুত আমার গতি, শুনেছি দৃষ্টি আমার তীক্ষ্ম, নাক চিবুক কপাল নিয়ে সুস্পষ্ট জোরালো আমার চেহারা। এপ্‌স্টাইন পাথরে আমার মূর্তি গড়তে চেয়েছিল, সময় দিতে পারি নি। কিন্তু বাঙালিকে আমি মায়ের খোকা বলে জানি, আর মায়েরা তাদের কোলের ধনকে মোমে-গড়া পুতুলের মতো দেখতেই ভালোবাসে। এ-সব কথা মনের মধ্যে ঘুলিয়ে উঠে আমাকে রাগিয়ে তুলছিল। আগেভাগেই কল্পনায় ঝগড়া করছিলুম অচিরার সঙ্গে, বলছিলুম, ‘তুমি যাকে বলো সুন্দর সে বিসর্জনের দেবতা, তোমাদের স্তব যদি বা পায় সে, টেঁকে না বেশিদিন।’ বলছিলুম, ‘আমি বড়ো বড়ো দেশের স্বয়ংবরসভার মালা উপেক্ষা করে এসেছি, আর তুমি আমাকে উপেক্ষা করবে?’ গায়ে প’ড়ে এই বানানো ঝগড়া এমনি ছেলেমানুষি যে, একদিন হেসে উঠেছি আপন উষ্মায়। এ দিকে বিজ্ঞানীর যুক্তি কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। মনকে জানাই, এটাও একটা মস্ত কথা, আমার যাতায়াতের পথের ধারে ও বসে থাকে— একান্ত নিভৃতই যদি ওর প্রার্থনীয় হত, তা হলে ঠাঁই বদল করত। প্রথম প্রথম আমি ওকে আড়ে আড়ে দেখেছি, যেন দেখি নি এই ভান করে। ইদানীং মাঝে মাঝে স্পষ্ট চোখাচোখি হয়েছে— যতদূর আমার বিশ্বাস, সেটাতে চার চোখের অপঘাত বলে ওর মনে হয় নি।

এর চেয়েও বিশেষ একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। এর আগে দিনের বেলায় মাটিপাথরের কাজ সাঙ্গ করে দিনের শেষে ঐ পঞ্চবটীর পথ দিয়ে একবারমাত্র যেতেম বাসার দিকে। সম্প্রতি যাতায়াতের পুনরাবৃত্তি হতে আরম্ভ হয়েছে। এই ঘটনাটা যে জিয়লজি সম্পর্কিত নয়, সে কথা বোঝবার মতো বয়স হয়েছে অচিরার, আমারও সাহস ক্রমশ বেড়ে চলল যখন দেখলুম, এই সুস্পষ্ট ভাবের আভাসেও তরুণীকে স্থানচ্যুত করতে পারল না। এক-একদিন হঠাৎ পিছন ফিরে দেখেছি, অচিরা আমার তিরোগমনের দিকে চেয়ে আছে, আমি ফিরতেই তাড়াতাড়ি ডায়ারির দিকে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সন্দেহ হল, ওর ডায়ারি লেখার ধারায় আগেকার মতো বেগ নেই। আমার বিজ্ঞানী বুদ্ধিতে মনোরহস্যের আলোচনা জেগে উঠল।