প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
১০৫
পূর্ব্বে যাহা কিছু আমি মন্দ এবং হীন বলিয়া মনে করিতাম–চাষীদের গ্রাম্যতা, মোটা ভাত, মোটা কাপড়, সাদাসিধা রকমের বাসস্থান ও চালচলন–এ সকলই আমার চক্ষে ভালো এবং মহৎ হইয়া উঠিয়াছে। যাহা বাহ্যত আমাকে অন্য সকলের ঊর্দ্ধে তুলিয়া দেয়, যাহা তাহাদের হইতে আমাকে পৃথক্ করিয়া দেয়, এমন কিছুতে এখন আমি যোগ দিতে পারি না। পূর্ব্বের ন্যায় এখন আমি আর নিজের সম্বন্ধে বা অন্যের সম্বন্ধে কোনো পদবী পদ বা গুণকে মানবসাধারণের পদবী বা গুণের চেয়ে বড়ো করিয়া স্বীকার করিতে পারি না। আমি যশ বা প্রশংসা সন্ধান করিয়া ফিরিতে পারি না, আমি এমন কোনো উৎকর্ষ কামনা করি না যাহা মানবসাধারণ হইতে আমাকে স্বতন্ত্র করে। আমার সমস্ত সত্তায়–আমার বাসস্থানে, অশন বসনে, আমার লোকব্যবহারে, যাহা কিছু জনসাধারণ হইতে আমাকে বিচ্ছিন্ন না করে, পরন্তু তাহাদের নিকট আকর্ষণ করে, তাহাই কামনা না করিয়া আমি থাকিতে পারি না।
১০৬
অতি শৈশবকালেই সমুদ্রশুশুকের সহিত আমার প্রথম পরিচয় হয়। লণ্ডন হইতে বৃটিশ গায়েনার ডেমেরারা’তে আমার প্রথম সমুদ্রযাত্রাকালে ইহা ঘটে। আকাশ অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল এবং উত্তর আট্লান্টিকের শৈবালাচ্ছন্ন যে আবর্ত্ত সারাগাসো-সাগর নামে সুবিখ্যাত তাহাই পার হইবার সময় আমাদের পুরাতন জাহাজে অলস বায়ুর বেগ এত দুর্ব্বল ছিল যে, সেই তৃণবর্ণ পিণ্ডগুলিকে ঠেলিয়া আমরা অনেক সময়ে প্রায় পথ করিতে পারিতেছিলাম না। ক্ষণে ক্ষণে আরমা এই সকল শৈবালের মধ্যে বিস্তৃত ফাঁকা জায়গা পাইতেছিলাম, সেইসকল পরিষ্কার স্থানের কোনো একটিতে মন্দ গমনে চলিতে চলিতে সহসা আমরা এক বৃহৎ ঝাঁক মাছের মধ্যে আসিয়া পড়িলাম। তাহারা সংখ্যায় বহু সহস্র হইবে এবং তাহারা চলমান সৈন্যগণের মতো নিবিড়ভাবে দল বাঁধিয়া সাঁতার দিতেছিল।
১০৭
একই মুহূর্ত্তে উহারা সকলে যখন পাশ ফিরিল, উহাদের শরীর হইতে তখন একটি আভা প্রক্ষিপ্ত হইল; যেন প্রকাণ্ড একখানি দর্পণ সূর্য্যালোক্কে আমার চক্ষুর উপরে কেন্দ্রীভূত করিয়া অকস্মাৎ আবর্ত্তন করিল। উত্তেজনায় পূর্ণ হইয়া একটি নাবিককে রেলিঙের নিকট লইয়া গিয়া সেখান হইতে ঝাঁকটি নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহারা কী?” একবার মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া এবং “শুশুক” এই একটি কথা বলিয়াই সে ছুটিয়া চলিয়া গেল এবং ব্যাপারটা যে কী ইহাই আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম। বাকি দিনটা এই সব সুন্দর মাছ আরো বেশি করিয়া দেখিবার কামনা হইতে আমি মুক্তি পাইলাম না। আমি তাহাদের প্রতি এমনই সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়াছিলাম, যেন উহাদিগকে আবিষ্কার করার উপরেই আমার জীবন নির্ভর করিতেছে।
১০৮
সহসা ইহাদের এই নিবিড়সম্বদ্ধ স্তূপের মধ্যে উহাদের একটি স্বজাতীয় প্রাণী তীরবেগে আসিয়া পড়িল–সে উহাদের অপেক্ষা অনেক বৃহত্তর, অন্ততঃ পক্ষে দৈর্ঘ্যে ছয় ফুট এবং সেই অনুপাতেই চওড়া হইবে। আমি দেখিলাম, উহারা লক্ষ্যশূন্যভাবে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল, যেন জানে না কোথায় পালাইতে হইবে। এই সন্ত্রস্ত তরুণ প্রাণীগুলির মধ্যে উক্ত স্বজাতিখাদক যখন ইতস্তত তীরবেগে ছুটিতে লাগিল তখন তাহাকে ক্ষণকালের জন্য অস্পষ্ট দেখিতে পাওয়া গেল; তাহার পরে জল রক্তে এবং মৎস্যের ভাসমান ছিন্নাংশে এমন মলিন হইয়া গেল যে, কিছুক্ষণের মতো আর এই উৎপাত দেখিতে পাইলাম না।
১০৯
সমুদ্রশুশুকের জীবন নিশ্চয়ই অত্যন্ত সুখের হইবে, কারণ সে বিনা বাধায় মহাসমুদ্র-সকলের উন্মুক্ত প্রসারতার মধ্যে ভ্রমণ করিয়া থাকে। উহার যেসব শত্রু আছে তাহাদিগকে বেগে ছাড়াইয়া চলিতে ও এড়াইয়া যাইতে সে খুবই সমর্থ। সময় সময়ে অসতর্ক হইয়া সে হাঙ্গরের শিকার হইয়া পড়ে, কিন্তু আমার মনে হয় ইহা কদাচিৎ ঘটিয়া থাকে। এরূপ এক ঘটনা আমি একবার দেখিয়াছিলাম।