প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
প্রশান্ত মহাসাগরে, সম্পূর্ণ এক শান্ত দিনে মাস্তুলের উপরিস্থিত আমার আশ্রয়স্থান হইতে নীলসমুদ্রের তলে যাহা কিছু ঘটিতেছে একটি শক্তিশালী দূরবীণের মধ্য দিয়া সেসমস্তই অত্যন্ত পরিষ্কাররূপে দৃষ্টিগোচর হইতেছিল। খুব কাছেই প্রকাণ্ড এক কাঠের গুঁড়ি ভাসিতেছিল। ইহা নিরীক্ষণকালে জমকালো এক সমুদ্রশুশুক দেখিতে পাইলাম–ইহার চর্ম্ম হইতে সূর্য্যকিরণে নীল এবং সোনালি আভা ঠিক্রাইতেছে; সে আলস্যভরে লেজ নাড়িতে নাড়িতে কাষ্ঠখণ্ডের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতেছে, মনে হয় যেন সে আহার করিয়া পরিতৃপ্ত।
১১০
ঠিক তাহার পশ্চাতে কাষ্ঠখণ্ডের তলদেশ হইতে এক অস্পষ্ট ছায়া নির্গত হইয়া উপরিভাগে উৎক্ষিপ্ত হইল, সেখানে এক ঘূর্ণি এবং আবিলতা দেখা দিল এবং ঐ সৌখিন সমুদ্রজীবটি দুই খণ্ডে বিভক্ত হইয়া গেল; উহার একখণ্ড চতুর হাঙ্গরের গলার মধ্য দিয়া অদৃশ্য হইল। অবশ্য দ্বিতীয় অর্দ্ধাংশও সত্বর প্রথমকে অনুসরণ করিয়া হাঙ্গরের কণ্ঠ দিয়া নামিয়া গেল–এবং তখন শেষোক্ত প্রাণীটিও পুনরায় আপনাকে প্রচ্ছন্ন করিল। আমি লক্ষ্য করিলাম, তিনবার এই হাঙ্গর এইরূপ কৌশলে কৃতকার্য্য হইল; কিন্তু একমাত্র এই উপলক্ষ্যেই আমি দেখিলাম যে, একটি শুশুক চতুরতায় একটি হাঙ্গর-কর্ত্তৃক পরাভূত হইয়াছে।
১১১
মধ্যযুগে লোকের এইরূপ বিশ্বাস ছিল যে, এক সহস্র খৃষ্টীয় শকে জগতের নিশ্চিত অবসান ঘটিবে। খৃষ্টান সমাজ এই বিশ্বাস লইয়াই জীবননির্ব্বাহ করিত এবং যে ব্যক্তি ইহাতে সন্দেহ করিত সে শাস্ত্রদ্রোহী বলিয়া গণ্য হইত। মধ্যযুগের অধিকাংশ আইন ও রাজদত্ত দলিল “জগতের আসন্ন দিনান্তকালে” এই বাক্যের দ্বারা আরম্ভ করা হইত। দশম শতাব্দীর সমাপ্তি যখন নিকটতর হইয়া আসিল তখন ভয়ের পরিমাণও বাড়িয়া উঠিল। য়ুরোপ যেন তখন তাহার শেষ উইল লিখিয়া সারিল এবং চার্চ্চ্কে যাহা দান করা হইল তাহার অধিকাংশের তারিখ সেই যুগ হইতেই সুরু। লোকেরা তাহাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে ইচ্ছা করিল। তাহারা চার্চ্চকে আপন সম্পত্তি দিয়া ফেলিল, বস্তুত সে সম্পত্তিতে তাহাদের আর অধিক প্রয়োজন থাকার কথা ছিল না; এবং সেই একই কারণে সরকারী সম্পত্তির অধিকাংশই পুরোহিতসম্প্রদায়ের অধিকারে আসিল। কিন্তু এক হাজার সালও কাটিয়া গেল এবং আমাদের ভূমণ্ডল তাহার কক্ষের চতুর্দ্দিকে আবর্ত্তন বন্ধ করিল না। তখন হইতে জগতের অন্ত-সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করিতে অল্প লোকই সাহস করিয়াছে।
১১২
পুরাকালে লোকেরা ধূমকেতুর সহিত সংঘাতকে ভয় করিত, কিন্তু যখন হইতে এই নভশ্চর পদার্থসকল আমাদের নিকট অধিকতর সুবিদিত হইয়াছে তখন তাহারা আর কাহাকেও ভয় দেখাইতে পারে না। ধূমকেতু কোনো প্রাণীর ক্ষতি করিয়াছে এমন একটি ঘটনারও উল্লেখ করা যাইতে পারে না। তাহাদের পুচ্ছ এত সূক্ষ্ম গ্যাসে নির্ম্মিত যে, বহু সহস্র মাইল পুরু হইলেও তাহা একগ্লাস জলের মতোই স্বচ্ছ। এরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ আছে যে, এই গ্যাস বেন্জইন অথবা পেট্রোলিয়ম বাষ্পের দ্বারা গঠিত, কিন্তু ধূমকেতুর যে পুচ্ছ বিমানপথচারী দুই জ্যোতিষ্কের মধ্যবর্ত্তী আকাশের সেতু রচনা করিতে পারে তাহার সমস্ত উপাদান সম্ভবত কয়েকটি মাত্র পিপার সামান্য স্থানের মধ্যে প্রবেশযোগ্য। অতএব পেট্রোলিয়ম-বর্ষণ আশঙ্কা করিবার প্রয়োজন নাই।
১১৩
কিন্তু অন্যসকল বিপত্তি আছে। আমাদের জীবিতকালের মধ্যেই দেখিয়াছি বাহিরের কোনও কারণ ব্যতিরেকেও আমাদের ভূমণ্ডল বিদীর্ণ হইয়াছে। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে আগষ্ট্ মাসে সুণ্ডা দ্বীপে কারাগাতোয়া-নামক একটি ক্ষুদ্র জ্বালামুখীর সমুদ্রতলবর্ত্তী একটি স্থানে এইরূপ ঘটিয়া অগ্নিময় গর্ত্তের মধ্যে সমুদ্রজলের প্রবেশপথ হইয়াছিল। অগ্নিগহ্বর সমুদ্রকে মেঘলোকে উৎক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছিল;