শেষ কথা

অচিরা বলে উঠল, “দাদু, সাধে তোমাকে বলি ছেলেমানুষ। যখন-তখন নেমন্তন্ন করে তুমি আমাকে মুশকিলে ফেল। এই দণ্ডকারণ্যে ফিরপির দোকান পাব কোথায়। ওঁরা বিলেতের ডিনার খাইয়ে জাতের সর্বগ্রাসী মানুষ,কেন তোমার নাতনির বদনাম করবে। অন্তত ভেটকিমাছ আর ভেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো।”

“আচ্ছা, আচ্ছা, তা হলে কবে আপনার সুবিধে হবে বলুন।”

“সুবিধে আমার কালই হতে পারবে। কিন্তু অচিরাদেবীকে বিপন্ন করতে চাই নে। ঘোর জঙ্গলে পাহাড়ে গুহাগহ্বরে আমাকে ভ্রমণে যেতে হয়। সঙ্গে রাখি থলে ভরে চিঁড়ে, ছড়াকয়েক কলা, বিলিতি বেগুন, কাঁচা ছোলার শাক, চিনেবাদামও কখনো থাকে। আমি সঙ্গে নিয়ে আসব ফলারের আয়োজন, অচিরাদেবী দই দিয়ে স্বহস্তে মেখে আমাকে খাওয়াবেন, এতে যদি রাজি থাকেন তা হলে কোনো কথা থাকবে না।”

“দাদু, বিশ্বাস কোরো না এ-সব লোককে। তুমি বাংলা-মাসিকে লিখেছিলে বাঙালির খাদ্যে ভিটেমিনের প্রভাব,সে উনি পড়েছেন, তাই কেবল তোমাকে খুশি করবার জন্যে চিঁড়েকলার ফর্দ তোমাকে শোনালেন।”

আমি ভাবলুম, মুশকিলে ফেললে। বাংলা কাগজে ডাক্তারের লেখা ভিটামিনের তত্ত্ব পড়া কোনোকালে আমার দ্বারা সম্ভব নয়; কিন্তু কবুল করি কী করে।— বিশেষত উনি যখন উৎফুল্ল হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সেটা পড়েছেন নাকি।”

আমি বললুম, “পড়ি বা না-পড়ি তাতে কিছু আসে যায় না, আসল কথা—”

“আসল কথা, উনি নিশ্চয়ই জানেন কাল যদি ওঁকে খাওয়াই, তা হলে ওঁর পাতে পশুপক্ষী স্থাবরজঙ্গম কিছুই বাদ পড়বে না। সেইজন্যে, অত নিশ্চিন্ত মনে বিলিতি বেগুনের নামকীর্তন করলেন। ওঁর শরীরটার দিকে দেখো-না চেয়ে, শুধু শাকান্নে গড়া ব’লে কেউ সন্দেহ করতে পারে? দাদু, “তুমি সবাইকেই অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস কর, এমন-কি, আমাকেও। সেইজন্যে ঠাট্টা করে তোমাকে কিছু বলতে সাহস করি নে।”

বলতে বলতে ধীরে ধীরে আমরা ওঁদের বাড়ির দিকে চলেছি, এমন সময় হঠাৎ অচিরা বলে উঠল, “এইবার আপনি ফিরে যান বাসায়।”

“কেন, আমি ভেবেছিলুম আপনাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।”

“ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। আপনি বলবেন, বাঙালি মেয়েরা সব অগোছালো। কাল এমন ক’রে সাজিয়ে রাখব যে মেমসাহেবের কথা মনে পড়বে।”

অধ্যাপক বললেন, “আপনি কিছু মনে করবেন না ডক্টর সেনগুপ্ত, অচি বেশি কথা কচ্ছে, কিন্তু ওর স্বভাব নয় সেটা। এখানে বড়ো নির্জন ব’লে ও জুড়ে রাখে আমার মনকে অনর্গল কথা কয়ে। সেটাই ওর অভ্যেস হয়ে গেছে। ও যখন চুপ করে থাকে তখনই আমার ঘরটা যেন ছম্‌ছম্‌ করতে থাকে, আমার মনটাও। ও জানে সে কথা। আমার ভয় করে পাছে ওকে কেউ ভুল বোঝে।”

বুড়োর গলা জড়িয়ে ধ’রে অচিরা বললে, “বুঝুক-না দাদু, অত্যন্ত অনিন্দনীয়া হতে চাই নে, সেটা অত্যন্ত আন-ইন্টারেস্টিঙ।”

অধ্যাপক সগর্বে বলে উঠলেন, “জানেন সেনগুপ্ত, আমার দিদি কিন্তু কথা কইতে জানে, অমন আমি কাউকে দেখি নি।”

“তুমি আমার মতো কাউকে দেখো নি দাদু, আমিও কাউকে দেখি নি তোমার মতো।”

আমি বললুম, “আচার্যদেব, যাবার আগে আমাকে কিন্তু একটা কথা দিতে হবে।”

“আচ্ছা বেশ।”