প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
১৮০
গাড়ীখানা সম্পূর্ণ নূতন এবং বেশ ভালো; ঘোড়াগুলি অতি উৎকৃষ্ট। অর্দ্ধ ঘন্টারও অল্প সময়ে আমরা বিয়ারিজে আসিয়া পড়িলাম। সেখানে পৌঁছিয়া, সস্তা চুক্তির সুবিধা গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক ছিলাম বলিয়া আমি টাকার থলি হইতে পনেরোটি সূ লইলাম এবং গাড়োয়ানকে তাহাই দিলাম। আমি চলিয়া যাইতে উদ্যত ছিলাম, কিন্তু সে আমার হাত ধরিল। সে বলিল, “মহাশয়, আমার প্রাপ্য মাত্র তিন সূ।” আমি উত্তর করিলাম, “হাঁঃ! তুমি আমাকে প্রথমে পনেরো সূ বলিয়াছিলে। পনেরো সূই দিব।” “মোটেই না সহেব! আমি বলিয়াছিলাম আপনাকে তিন সূঞ্চতে লইব, সুতরাং ভাড়া তিন সূ।” এবং উদ্বৃত্ত মুদ্রা ফিরাইয়া দিয়া প্রায় জোর করিয়া সে আমাকে তাহা গছাইয়া দিল। আমি যাইতে যাইতে বলিলাম, “লোকটা খাঁটি বটে!” অন্যান্য যাত্রীরাও আমার মতো তিন সূ মাত্রই দিয়াছিল।
১৮১
সারাদিন সমুদ্রতীরে ঘুরিয়া বেড়াইবার পর সন্ধ্যা হইয়া আসিল এবং আমি Bayonne-এ ফিরিবার কথা চিন্তা করিতে লাগিলাম। আমি ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম এবং যে উৎকৃষ্ট যান ও সাধু সারথি আমাকে সেখানে পৌঁছাইয়া দিয়াছিল তাহারই কথা স্মরণ করিয়া আমি বিশেষ কিছু আনন্দ বোধ করিলাব। যখন আমি পুরাতন বন্দর হইতে ফিরিবার মুখে ঢালু পথে উঠিতেছিলাম তখন সমতল দেশে দূরের ঘড়িগুলিতে আটটা বাজিতেছিল। চারি দিক হইতে যে সব পদাতিক ভীড় করিয়া আসিতেছিল, এবং মনে হইল তাহারা গ্রামের প্রবেশপথে গাড়ী দাঁড়াইবার জায়গায় যাইতেছে, তাহাদের প্রতি কোনও মনোযোগ দিই নাই। সন্ধ্যাটি চমৎকার হইয়াছিল, কয়েকটি তারা যেন গোধূলির নির্ম্মল আকাশ বিদীর্ণ করিতে সুরু করিয়াছিল; শান্তপ্রায় সমুদ্রে বিপুল তৈলাস্তরণের মতো একটি নিস্তেজ অস্বচ্ছ আভা বিরাজ করিতেছিল।
১৮২
অন্ধকার নিবিড়তর হইয়া উঠিল এবং অকস্মাৎ কোন্ এক সময়ে Bayonneনগর এবং আমার সরাইখানার চিন্তা আমার ধ্যানের মাঝখানে আসিয়া পড়িল। আমি আবার চলা আরম্ভ করিলাম এবং যে জায়গা হইতে গাড়ী ছাড়ে সেইখানে আসিয়া পৌঁছিলাম। একটিমাত্র গাড়ী অবশিষ্ট ছিল। ভূমিতলে স্থাপিত একটি প্রকাণ্ড লণ্ঠনের আলোকে আমি তাহা দেখিলাম। ইহা চারি জনের সীট-বিশিষ্ট গাড়ী। তিনটি সীট ইতিমধ্যেই অধিকৃত। আমি নিকটস্থ হইতে একটি চীৎকার-স্বর উঠিল, “এই যে সাহেব, শীঘ্র করুন, একটি শেষ সীট এবং আমাদেরই শেষ গাড়ী।” আমি আমার সকাল বেলাকার সারথির কণ্ঠস্বর চিনিলাম। মনুষ্যজাতীয় সেই অপূর্ব্ব পদার্থটিকে আমি পুনর্ব্বার পাইলাম। এই সৌভাগ্য আমার নিকট দৈবঘটিত বোধ হইল এবং আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। আর এক মুহূর্ত্ত দেরি করিলেই পদব্রজে যাত্রা করিতে বাধ্য হইতাম–খাঁটি দেড় ক্রোশ পল্লীপথ। আমি বলিলাম, “তোমাকে আবার দেখিয়া আনন্দিত হইলাম।” লোকটি উত্তর দিল, “মহাশয়, তাড়াতাড়ি ঢুকিয়া পড়ুন।” আমি সত্বর নিজেকে গাড়ীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিলাম।
১৮৩
আমি উপবিষ্ট হইলে পর সারথি দরজার হ্যাণ্ডেলে হাত রাখিয়া আমাকে বলিল, “মহাশয়, জানেন কি যে, ঘন্টা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে মি বলিলাম, “কিসের ঘন্টা?” “আটটা।” “ঠিক কথা। আমি ঐ রকমই বাজিতে শুনিয়াছি বটে।” উত্তরে লোকটি বলিল, “সাহেব, জানেন যে, সন্ধ্যার আটটার পর ভাড়ার পরিবর্ত্তন হয়। রওয়ানা হইবার পূর্ব্বেই ভাড়া দেওয়া দস্তুর।” আমি টাকার থলিটা টানিয়া বাহির করিয়া উত্তর দিলাম, “নিশ্চয়ই, কত ভাড়া?” লোকটি মিষ্টস্বরে উত্তর দিল, “বারো ফ্রাঙ্ক্ সাহেব!” তৎক্ষণাৎ কার্য্যপ্রণালীটি বুঝিলাম। প্রাতঃকালে ইহারা লোকপিছু তিন সূ হারে দর্শকদিগকে বিয়ারিজে গাড়ী করিয়া লইয়া যাইবে বলিয়া ঘোষণা করে এবং তখনই ভীড় জমিয়া যায়। সন্ধ্যায় লোকপিছু বারো ফ্রাঙ্ক্ হারে ইহারা সেই ভীড়টিকে Bayonne-এ ফিরাইয়া আনে।