প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
১৯২
আমাদের ভ্রমণকারীগণ পুনর্ব্বার অশ্বারোহণ করিয়া পার্ব্বত্য প্রদেশাভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন; এইবার একটি তরুণ সেনানায়কের অধীনে অশ্বারোহীদলের অনেকগুলি সৈন্য তাঁহাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করিয়াছে। তাঁহারা দস্যুর দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে যাইতেছেন বলিয়া সৌজন্য-সহকারে এই শরীররক্ষীর দল তাঁহাদিগকে দান করা হইয়াছে। সুন্দর একটি ছোটো ঘোড়ায় চড়িয়া ঐ যে হিংস্রমূর্ত্তি ব্যক্তি সমস্ত বাহিনীকে পথ দেখাইয়া যাইতেছে, ও কে–এই কি তোমার প্রশ্ন? ঐ ব্যক্তি একজন বিখ্যাত দস্যু, নাম Andrea Puzzu, ও শুধু দস্যু নয় সর্ব্বাপেক্ষা অপকৃষ্ট শ্রেণীর একজন দস্যু–অপকর্ম্মকারী দানববিশেষ; উহাকে যে রাগাইয়াছে তাহার প্রাণ লওয়া একটা কাকের প্রাণ লওয়ার চেয়ে উহার কাছে অধিক বলিয়া মনে হয় না। যাহা হউক, সে এখন অঙ্গীকারবদ্ধ অবস্থায় আছে এবং সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে যে, ঐ অশ্বারোহী দলটিকে সে লিম্বাবা গিরিশ্রেণীর দুর্গম বাধাসকলের মধ্য দিয়া নিরাপদে লইয়া যাইবে; এবং এ কাজে সে ব্যর্থ হইবে না, কারণ নির্দ্দয় দস্যু হইলেও সে আতিথ্যধর্ম্ম ভঙ্গ করিবে না।
১৯৩
ঐ পীড্মন্ট্দেশীয় তরুণ সেনানায়ক বিশেষরূপে প্রিয়দর্শন, চলনসই ধরণের শিক্ষিত, অতিশয় বিনীত। তিনি দলস্থ অল্পবয়স্ক ব্যক্তিদিগকে সাসারীয় (Sassarese) লোকসমাজ-সম্বন্ধে শত শত ক্ষুদ্র কাহিনী বলিয়া আমোদ দিতেছেন। ইটালীয় মাত্রেরই ন্যায় তিনিও সার্ডিনিয়ার উপর সম্পূর্ণ বীতরাগ এবং আগামী শরৎকালে কখন্ তিনি তাঁহার প্রিয় Turin-এ ফিরিয়া যাইবেন, যেন তাহারই প্রত্যেক ঘন্টা গুনিতেছেন। তিনি বলেন, “আমার এক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যখন ঐ প্রচণ্ড দস্যুদিগের বিরুদ্ধে প্রেরিত একটি ক্ষুদ্র দলের অধিকনায়কত্ব করিতেছিলেন, তখন এই পর্ব্বতগুলির মধ্যেই কোনো এক স্থানে তিনি বন্দুকের গুলিতে নিহত হন।” ঐ দস্যুগণ চিরকালই গভর্ণমেন্টের পক্ষে আপদ্স্বরূপ, উহাদের চিন্তা মনে আসাতেই যে তিনি শিহরিয়া উঠেন তাহাতে বিষ্ময়ের বিষয় কিছুই নাই। তাঁহার যুবক ভ্রাতাটি সেরা মানুষ ও সাহসী সেনানায়ক ছিলেন। নরঘাতক প্রচ্ছন্ন আক্রমণকারী দস্যুদলের হস্তে নিহত হওয়া অপেক্ষা মহত্তর দশা যে তাঁহার ভাগ্যে ঘটিল না, ইহাতে তিনি খেদ না করিয়া থাকিতে পারেন না।
১৯৪
“কিন্তু ভগবান তাঁহার আত্মাকে শান্তি দিন” বলিয়া ঐ যুবক নম্রভাবে মস্তক নত করিলেন, উষ্ণ অশ্রুতে তাঁহার সুন্দর চক্ষু দুটিকে ঝাপসা ও তাঁহার কণ্ঠ রুদ্ধ করিয়া দিল। তিনি বলিলেন, “যাক, উহা ভগবানের ইচ্ছা, এখন ঐ দস্যুগণ অপেক্ষাকৃত ভদ্র হইয়াছে। কিন্তু ঐ ভয়াবহ রাক্ষস পুজ্জু–”, –তাঁহারা কি পুজ্জুদিগের কথা কখনও শুনিয়াছেন? তাঁহারা কি মেষপালক Scaoccatos-এর হত্যার কাহিনী কখনও শুনিয়াছেন? ঐ কাহিনী শ্রবণযোগ্য বটে, এবং তাঁহারা উহা যদি শুনিতে চাহেন তাহা হইলে অশ্বারোহীদলের পশ্চাদ্ভাগে Padre Antomio নামে যে এক ব্যক্তি তাঁহার গিরিসঙ্কটমধ্যস্থ পৌরোহিত্যকর্ম্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে চলিয়াছেন, তিনি যদি বারেকের মতো তাঁহার বৈকালিক নিদ্রা ত্যাগ করিতে সম্মত হন, তবে মধ্যাহ্নভোজনের পর ঐ কাহিনী সবিশেষ বিবৃত করিয়া সমাগত ব্যক্তিবৃন্দকে তুষ্ট করিবার জন্য ঐ পীড্মন্ট্বাসী তাঁহাকে অনুরোধ করিবেন।
১৯৫
সকলেই রাজী হইলেন এবং যুবক সেনাপতি ঐ প্রস্তাব করিবার জন্য সত্বর বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগে গেলেন। ইত্যবসরে ঐ অশ্ববাহিনী পর্ব্বতশ্রেণীর মধ্য দিয়া দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল। সেখানকার দৃশ্য বিচিত্র ও সুন্দর এবং চারি দিকের ধ্বনি সেগুলিও কী মনোহর! বহুদূরে একটি গ্রাম্য গির্জ্জার ঘন্টা আপনার শ্রুতিমধুর শব্দ প্রেরণ করিতেছে ও তাহা নির্ম্মল ও সুখস্পর্শ বায়ুর মধ্য দিয়া ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হইতেছে। তাহা ছাড়া মেষদলের গলঘন্টার ঝঙ্কার, মেষ ও ছাগের ডাক, কুকুরের চীৎকার, মেষপালকের একঘেয়ে বাঁশীর সুর এবং মধ্যে মধ্যে কৃষকের সঙ্গীত; তাহার উপরে পাখীর গানও ছিল–কারণ ইটালীতে পাখী দুর্লভ হইলেও এখানে যথেষ্ট পরিমাণেই আছে এবং ঐ যে পর্ব্বতচূড়ার দিকে উড়িয়া যাইতেছে উহা একটি ঈগলপক্ষী নয় কি?