প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
২০৬
উন্মুক্ত কফিনের ভিতর হতব্যক্তিগণের দেহ রক্ষিত হইল, প্রত্যেকেরই বক্ষঃস্থলে এক একটি ক্রুশ। ভাড়া করা বিলাপকারিণীর দল আসিয়া পৌঁছিল–আপনারা জানেন যে, উহা অতি প্রাচীন প্রথা, অন্য দেশে বোধ করি উহা বহুকাল হইল আর পালিত হয় না–যাহা হউক, তাহারা অসংযত অঙ্গভঙ্গী-সহকারে, আলুলায়িতকেশে ভয়াবহ চীৎকার করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং অনতিবিলম্বে তাহাদের দলের নেত্রী হত স্ক্যাকাটোসের দেহের ঊর্দ্ধে বাহু বিস্তার করিয়া দাঁড়াইল এবং গম্ভীর অপার্থিব কণ্ঠে কথাগুলি বলিতে লাগিল, “চাহিয়া দেখো, বলশালী ব্যক্তি আজ ধূলায় লুণ্ঠিত, সাধু ব্যক্তি আজ দস্যুহস্তে ভূপতিত। হায়, হায়, হায়! তাঁহার জীবন উর্ব্বরা গোচারণভূমির মধ্য দিয়া প্রবাহিত নদীর ন্যায় ছিল, উহা চারি দিকে উর্ব্বরতা দান করিত। হায়, হায়, হায়! তাঁহার জীবনের দিনগুলি কী শান্তিপূর্ণ ও অক্ষুব্ধ ছিল, উহা চতুর্দ্দিকে আশিস বর্ষণ করিত। হায়, হায়, হায়! কারণ, তিনি সিংহের ন্যায় বীর্য্যবান ও সাহসী অথচ কপোতের ন্যায় মৃদুস্বভাব ছিলেন। হায়, হায়, হায়! কারণ তাঁহার আত্মা অগ্নিশিখার ন্যায় নির্ম্মল এবং তাঁহার বাক্য মধুর ন্যায় মিষ্ট ছিল। হায়, হায়, হায়!”
২০৭
“কিন্তু তোমার ঋণ পরিশোধ হইবে, তোমার ক্ষতস্থান ঐ শত্রুর বক্ষেই প্রত্যাবর্ত্তিত হইবে। হায়, হায়, হায়! পার্ব্বত্য গৃধিনী তাহার দেহ ভোগ করিবে এবং দাঁড়কাক তাহার চক্ষু উৎপাটিত করিয়া ফেলিবে। হায়, হায় হায়! তোমার রক্তাক্ত অঙ্গাবরণ তোমার প্রতিশোধকারীদিগের হস্তে অবতীর্ণ হইবে, রোষের বিগ্রহস্বরূপে তাহা বংশানুক্রমে রক্ষিত হইতে থাকিবে। হায়, হায়, হায়! অতএব তুমি তোমার নির্জ্জন সমাধিতে বিশ্রাম লাভ করো, কারণ তোমার হত্যার প্রতিশোধ লইতে বিলম্ব হইবে না। হায়, হায়, হায়! হাঁ, এইরূপই ঘটিবে, তোমার হইয়া পূরা প্রতিশোধ দেওয়া হইবে।” এই বলিয়া রমণী তাহার উগ্রবাক্ প্রবন্ধ সমাপ্ত করিল এবং শেষের দিকে তাহার চীৎকার উচ্চতর ও দীর্ঘতর হইয়া উঠিয়া নাড়ীতে নাড়ীতে যেন স্পন্দন জাগাইয়া তুলিল। তখন স্ক্যাকাটোস-গৃহিণী এক হস্তে হত স্বামীর রক্তাক্ত অঙ্গাবরণ লইয়া এবং অন্য হস্তে যে শিশুকে তিনি মদের পিপার ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন সেই নয় বৎসর বয়স্ক ক্ষুদ্র Michele-এর হস্ত ধারণ করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
২০৮
একবার সেই মৃতদেহের নিশ্চল বিবর্ণ মূর্ত্তির দিকে এবং একবার সেই রক্তরঞ্জিত স্মৃতিচিহ্নের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া এবং ঐ শিশুর ক্লিষ্ট মুখের দিকে স্থির-দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, “শপথ করো, মিকেল, শপথ করো যে, তুমি এই গর্হিত কার্য্যের প্রতিশোধ লইবে; স্বর্গবাসী সকল সাধুপুরুষের দোহাই যে, যত দিন না দস্যুর নিপাত হয় তত দিন তুমি কোনো আমোদ করিবে না এবং তোমার আত্মা কোনো শান্তি পাইবে না; আমি তোমাকে আজ্ঞা করিতেছি, শপথ করো, এবং ঐ শপথ তোমার বয়োবৃদ্ধির সহিত বর্দ্ধিত হউক, যত দিন পর্য্যন্ত ঐ ন্যায়ানুমোদিত প্রতিশোধ গ্রহণ করিবার মতো তোমার বাহু বলিষ্ঠ এবং চক্ষু স্থিরলক্ষ্য না হয়।” ঐ বালক খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “হে আমার পিতা, আমি তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ লইব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সাধুপুরুষগণ আমার সহায় হউন!” এবং ঐ ভীষণ বাক্য উচ্চারণকালে তাহার বিশাল নয়নদ্বয় বিস্ফারিত এবং তাহার আরক্ত ক্ষুদ্র অধরৌষ্ঠ দৃঢ় ও পাণ্ডুবর্ণ হইয়া উঠিল। তাহার শিশুমুখ হইতে যখন এক একটি করিয়া ঐ ভয়ানক কথা বাহির হইতে শুনিলাম তখন ভিতরে ভিতরে লোমহর্ষণ অনুভব করিলাম।
২০৯
মহাশয়গণ, আমার আর অল্পই বলিবার আছে, অতি অল্প। যদিও স্বদেশের প্রথা অনুসরণ করিয়া স্ক্যাকাটোস-গৃহিণী প্রতিবৎসর ঐ ভয়ানক দিনে তাঁহার পুত্রকে ঐ ভীষণ প্রতিজ্ঞার পুনরুচ্চারণ করাইতেন, তথাপি তিনি প্রতিশোধের আঘাত হানিবার জন্য উহার তরুণ বাহুর বললাভ ও দৃষ্টির অচপলতা-লাভের অপেক্ষা করেন নাই।