অনুবাদ-চর্চা

২০৩

রমণী আমাকে পরে বলিয়াছেন যে, তাঁহার সমস্ত শিরার ভিতর দিয়া যেন একটা হিমকম্পন প্রবাহিত হইয়া গেল এবং যন্ত্রের ন্যায় স্বামীর পদক্ষেপ অনুসরণ করিয়া উঠান পার হইয়া একটি বন্ধুর পার্ব্বত্য পথ অতিক্রম করিয়া কর্ক্‌ ও চেষ্টনাট বৃক্ষের একটি ক্ষুদ্র বনে গিয়া তিনি উপস্থিত হইলেন। সেখানে তিনি থামিলেন এবং ভূমিতলের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বিশেষ এক স্থান হইতে কতকগুলি মৃত্তিকার চাপ সরাইয়া দিতে সাহায্য করিবার জন্য তাঁহার পত্নীকে বলিলেন। তিনি তাহাই করিলেন এবং উভয়ে একত্র হইয়া বৃহৎ মাটির কলস তুলিলেন। অ্যান্‌ড্রিয়া বলিলেন, “এই কলসে ৪০০০ হাজার scudi স্বর্ণমুদ্রা আছে, উহা সারাজীবন নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রমের সঞ্চয়। আমি প্রয়োজনের দিনের জন্য ইহা সযত্নে রক্ষা করিয়াছি, কে যেন আমাকে বলিতেছে যে সেই সময় উপস্থিত। যে-কোনো একটা বহিরুৎপাতে হয়তো আমার প্রাণ যাইতেও পারে, এবং এই সম্বলে সম্বন্ধে তুমি অজ্ঞ থাকো ইহা আমার ইচ্ছা নহে।” এই বলিয়া তিনি সেই কলস যত্নপূর্ব্বক পুনর্ব্বার যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন, তাহা পুনর্ব্বার মাটির চাপড়া দিয়া আচ্ছাদিত করিলেন এবং ধীরে ধীরে গম্ভীরমুখে আপনার গৃহে ফিরিয়া আসিলেন।

২০৪

–এই স্থানে বেচারি পুরোহিত হৃদয়াবেগের প্রবলতায় অভিভূত হইয়া কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। –মহাশয়গণ (Signori), ইহা অতি ভয়ানক কাহিনী, অতি ভয়ানক! যাহা হউক, আমাকে আবার বলিতে হইবে। আমার এই সদ্যোবর্ণিত ঘটনাবলির পরদিনেরই সন্ধ্যাকালে অ্যান্‌ড্রিয়া স্ক্যাকাটোস এবং তাঁহার পরিবারবর্গ একত্র কাঠের আগুনের সম্মুখে বসিয়া ছিলেন, তাঁহাদের পরিবারটি বড়ো সুন্দর, অতি সুন্দর। তরুণ পিয়েট্রো ও তাহার বধূ এবং তিনটি ছোটে ভ্রাতা, তাহাদের মধ্যে একজন একান্তই শিশু। এই কাহিনী বলিতে আমার হৃদয় বিক্ষত হইয়া উঠিতেছে। স্ক্যাকাটোস-গৃহিণী সান্ধ্যভোজের অবশেষ তুলিয়া রাখিতে ভিতরের ঘরে প্রবেশ করিয়াছেন–এমন সময় কুকুরের প্রচণ্ড চীৎকার, যেন অশ্বারোহীদলের পদধ্বনি এবং রুদ্ধদ্বারে প্রবল আঘাতের শব্দ শোনা গেল। একটা আকস্মিক বেদনা যেন রমণীর হৃদয় ভেদ করিল, তিনি অনুভব করিলেন, সময় আসিতেছে এবং আপনার সর্ব্বকনিষ্ঠ এবং সম্ভবত প্রিয়তম পুত্রটিকে কোলে তুলিয়া লইয়া তিনি তাহাকে একটি শূন্য মদের পিপার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিলেন এবং বলিলেন, যদি সে বাঁচিতে চায় তবে যেন চুপ করিয়া থাকে।

২০৫

এ দিকে অ্যান্‌ড্রিয়া দৃঢ়স্বরে প্রশ্ন করিলেন, “বাহিরে কে?” “আমরা মিত্র” এই বিশ্বাসঘাতী উত্তর আসিল। তাঁহার পত্নী তাঁহার পার্শ্বে প্রত্যাগত হইয়া অনুনয় করিয়া বলিলেন, “স্বামিন্‌, আমি তোমাকে মিনতি করিয়া বলিতেছি তুমি দ্বার খুলিও না, উহা পুজ্জুর কণ্ঠস্বর।” “গৃহিণী আতিথেয়তার প্রয়োজনে ইহা করিতে হইবে, ইহা ধর্ম্মকার্য্য।” আবার দ্বারে আঘাত হইল, এবার প্রথম বারের অপেক্ষাও প্রবলতর শব্দে–”রাজার দোহাই, অ্যান্‌ড্রিয়া স্ক্যাকাটোস, তোমার দরজা খোলো, শীঘ্র খোলো।” দরজা খোলা হইল এবং অ্যান্‌ড্রিয়া স্ক্যাকাটোস জিওভ্যানি পুজ্জুর নিজ হস্তের গুলিতে হত হইয়া আপনার বীর্য্যবতী পত্নীর পার্শ্বে পড়িয়া গেলেন। তিনি ঐ ভয়ানক ব্যাপার সম্পূর্ণ সংঘটিত হইতে দেখিয়া, ঐ সশস্ত্র হত্যাকারীদলের ভিতর দিয়া যুঝিতে যুঝিতে, কয়েকটি ভীষণ আঘাত লাভ করা সত্ত্বেও বাহির হইয়া পলায়ন করিলেন। Giovanni Puzzu-কে সম্বোধন করিয়া একটি তরুণ কণ্ঠ কাতরভাবে বলিয়া উঠিল, “ধর্ম্মপিতা–দেবতার দোহাই, ভগবানের সহিত শান্তি স্থাপনের জন্য আমাকে একমুহূর্ত্ত জীবন ভিক্ষা দাও।” কিন্তু আবেদন বৃথাই হইল, বন্দুকের গুলি ছুটিল এবং যে গুলি তরুণ পিয়েট্রোর মস্তিষ্ক চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিল তাহাই তাহার সুশীলা বধূর বক্ষ ভেদ করিয়া গেল এবং এক একটি করিয়া তিনটি পুত্র ও একটি পুত্রবধূ ছিন্নভিন্ন মৃতদেহস্তূপে একত্র শায়িত হইল।