প্রদেশিক সভার উদ‍্‌বোধন

আমাদের বিপক্ষগণ সেই অন্যায় ধুয়া তুলিয়া আমাদের দাবিকে দুর্বল করিবার চেষ্টায় আছেন।

রাজপুরুষগণ কখনো কখনো মৌখিক রাজভক্তির উল্লেখ করিয়া অবঞ্জা প্রকাশ করেন, কিন্তু রাজদ্রোহও যে অনেক সময় মৌখিক হইতে পারে সে তাঁহার খেয়াল করেন না। হৃদয়ে আমাদের রাজদ্রোহ নাই, যদি কখনো চিত্তক্ষোভে অনবধানে মুখে বিরুদ্ধ কথা বাহির হয় তাহা কর্ণপাতের যোগ্য নহে।

জগদীশ্বরের রাজ্যই ধরণীশ্বরের রাজত্বের আদর্শ। ঈশ্বর মনুষ্যকে অনেক স্বাধীন অধিকার দিয়াছেন, মনুষ্য তাহার অসদ্‌ব্যবহার করিয়া পদে পদে দন্ডনীয় হয় কিন্তু তাই বলিয়া সমূলে স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত হয় না। আমাদের নরপতি, বিশ্বপতির এই বিধান স্মরণ রাখিলে রাজনীতির উচ্চ আদর্শ স্থাপন করিতে পারিতেন।

এই তো গেল রাজদ্রোহের ধুয়া। তাহার পরে আমাদিগকে বিবিধ প্রকারে দমনের জন্য আয়োজন নানা আকারে দেখা যাইতেছে। ইহার মূলে শাসনকর্তাদের ক্ষমতা, এবং প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধির চেষ্টা। ভারত-রাজতন্ত্রে বিচার বিভাগ এবং কর্তৃত্ব বিভাগের অধিকার, ন্যায়াধীশ এবং দন্ডাধীশের ক্ষমতা অনেক স্থলে একাধারে বর্তমান বলিয়া অনেক অন্যায়ের সৃষ্টি হইয়া থাকে—এই দুই ক্ষমতার পৃথকীকরণের জন্য দীর্ঘকাল আন্দোলন চলিতেছে, পাছে সেই যুক্তিযুক্ত আন্দোলন সফল হয় এইজন্যই বুঝিব তৎপূর্বেই কর্তৃপুরুষের ক্ষমতা অসংগতরূপে বৃদ্ধি করা হইতেছে।

অনেক সময় দন্ডাধীশ যাহাকে দোষী বলিয়া খাড়া করেন ন্যায়ধীশের বিচারে সে খালাস পায়—ইহাতে দন্ডবিধানের একটা ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু চাণক্যের ন্যায় আমাদের কর্তারা স্থির করিয়াছেন—“তাড়নে বহোবো গুণাঃ” – অতএব দমন-তাড়ানের শক্তিকে তাঁহার অপ্রতিহত করিতে চান। এক তো এমন এক ধারা বাহির হইল যাহাতে কোনো বিচারই নাই—তাহার পরে যেখানে বিচার আছে সেখানেও নূতন সংশোধিত দন্ডবিধি এমন সকল বাধা স্থাপন করিয়াছে, যাহাতে অভিযুক্তগণ আপন নিরপরাধ প্রমাণের চিরপ্রচলিত অনেকগুলি সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। সওয়াল-জবাবের অধিকার হ্রাস করা হইয়াছে; পুলিসের ডায়রি তদন্ত করিয়া কৃত্রিম প্রমান ধরিতে পারিবার যে উপায় ছিল তাহাও রোধ করা হইয়াছে; অবিচারের আশঙ্কায় এক হাকিমের হস্ত হইতে অন্য হাকিমের হস্তে মকদ্দমা চালান করিবার যে অধিকার ছিল তাহাও হ্রাস করা হইয়াছে। অবশ্য, বিচারকর্তারা অভিঞ্জতার দ্বারা কোনো ত্রুটি পাইয়া যদি এই-সকল বিধি সংশোধনের পরামর্শ দিতেন তাহা হইলেও বুঝিতাম—কিন্তু তাহা নহে—এ কেবল কর্তৃপুরুষদেরই কৃতকার্য। নূতন বিধি প্রণয়নে হাইকোর্টের এক জজ নিযুক্ত ছিলেন বটে—কিন্তু এই সংশোধনগুলি তাঁহার বিচার-করা-কালীন পরামর্শসম্ভূত নহে। একদিকে আইন কড়া, অন্য দিকে দন্ডবিধিও যদি সংকীর্ণ হয় তবে অভিযুক্তদিগের পক্ষে বড়োই সংকট। ইহা ব্রিটিশ ন্যায়নীতির বিরুদ্ধে। কারণ তাঁহাদের ন্যায়ের মূলসূত্র এই যে, ৯৯ জন অপরাধী খালাস পাইলেও ক্ষতি নাই কিন্তু একজনও নিরপরাধ যেন দন্ড না পায়।

কর্তৃপুরুষদের ক্ষমতাবৃদ্ধির এই চেষ্টা আমাদের প্রাদেশিক শাসনেও লক্ষিত হয়। প্রজাস্বত্বসম্বন্ধীয় নূতন আইনে খাস মহল এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহির্ভূক্ত মহলের প্রজাদের খাজানা বৃদ্ধির ক্ষমতা এক্ষণে একেবারে রেভিন্যু কর্মচারীদের হস্তে অর্পিত হইয়াছে। এই রেভিন্যু কর্মচারীরা কর্তৃবিভাগের অঙ্গ।

পূর্বে এই রেভিন্যু কর্মচারিদিগকে দেওয়ানীকার্যবিধি অনুসারে চলতি হইত, এবং তাঁহাদের রায়ের উপর সিভিল কোর্টে আপিল চলিবার বাধা ছিল না। নূতন নিয়ম অনুসারে তাঁহারাই সরাসরি ভাবে হুকুম দিবেন এবং তাহার উপরে আর আপিল চলিবে না। ইহাতে খাজানা বৃদ্ধির পথ সম্পূর্ণ অবাধ হইল। দুঃখের সহিত বলিতেছি আমাদের মধ্যে যাঁহারা মন্ত্রীসভায় এই আইনের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেন জমিদারসম্প্রদায় তাঁহাদিগকে উপলক্ষ করিয়া কনগ্রেসের প্রতি বিমুখভাব প্রকাশ করিয়াছেন।