আবদারের আইন
উপর হয়তো মাশুল বসে নাই; অথচ মূল্য তাহাদের বাড়িয়াছে। বাজারে যে দ্রব্যই দর কর সবই মহার্ঘ; বানিয়া বলে ‘মহাশয় মাশুল বসিয়াছে; কাজেই মহার্ঘ’। ইহা বানিয়ার চাতুরী অথবা ট্যারিফ তহশীলদারদের বাহাদুরি ঠিক বলা যায় না। তবে ট্যারিফের নিয়ম গঠনেও যে গলদ আছে ইহাও নিশ্চয়। আইনের উপস্থিত সংশোধনে সে দোষ দূরীভূত হইলেও হইতে পারে। কিন্তু কেবল করদ দ্রব্যের দুর্বোধ্য ও অনির্দিষ্ট শ্রেনী বাঁধিয়া দিলেই চলিবে না। পরন্তু কেবল ইন্ডিয়া গেজেটে ট্যারিফের নিয়মাবলী প্রকাশিত করিয়া তাহা বড়ো বড়ো বন্দরে প্রেরণ করা প্রচুর নহে। কোন্ কোন্ দ্রব্যের উপর আমদানি মাশুল বসিল তাহা নির্দিষ্ট ও পরিস্কারভাবে দেশীয় ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লিখিয়া সর্বসাধারণের বিদিতার্থে বাজারে প্রচার করা উচিত। নহিলে বিক্রেতা ক্রেতা উভয়েরই সংকট। এ বিষয়ে যে কেবল বড়ো বড়ো সওদাগরেরাই সংশ্লিষ্ট তাহা নহে। ক্ষুদ্র দোকানী পসারী ও দ্রব্যের খরচকারী ক্রেতা মাত্রেই ইহার সহিত জড়িত। অতএব অর্থসচিব শ্রীযুক্ত ওয়েস্টল্যান্ড বাহাদুর যে কেবল ইন্ডিয়া গেজেটের উপরেই নির্ভর করিতেছেন, ইহা ঠিক নহে।

গত মার্চ মাসে অনেকানেক আমদানি দ্রব্যের উপরেই মাশুল বসিয়াছিল; বসে নাই কেবল কাপড় ও সুতার উপরে। মাঞ্চিস্টার মাহাত্ম্যেই হউক কিংবা অন্য যে কারণেই হউক, সম্ভবত ম্যাঞ্চিস্টারের মহিমাতেই, সেক্রেটারি-অব্-স্টেট কাপড় সুতার মাশুল অনুমোদন করেন নাই। নহিলে ইন্ডিয়া গবর্নমেন্টের তাহাতে সবিশেষ ইচ্ছা না ছিল এমন নহে। স্টেট-সেক্রেটারি মি. ফাউলার সাহেবকে তাঁহার উক্ত অনভিমতের জন্য অনেক নিন্দা তিরস্কার ও লাঞ্ছনার ভাগী হইতে হইয়াছিল। কাউন্সিলের প্রায় সকল মেম্বরই তাঁহার প্রতি কুটিল কটাক্ষ করিয়াছিলেন। সরকারি সদস্যেরা সাফাই বলিয়াছিলেন যে, তাঁহারা হুকুমের চাকর সুতরাং কাপড় সুতার কর বসাইতেপারিলেন না। পরন্তু সাহেব সওদাগরেরা সাংঘাতিক রুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিলেন; একটা অস্বাভাবিক আন্দোলন উঠাইয়াছিলেন। নেটিব পেট্রিয়টেরা যাইয়া সে আন্দোলনে যেরূপে যোগ দন অগ্রে উল্লেখ করিয়াছি। কাপড় সুতার করের অভিলাষে আন্দোলন ভয়ানক ফাঁপিয়া উঠে। দেশীয় স্বদেশহিতৈষী ও সম্পাদকবর্গ একবাক্যে বলিয়া উঠেন—‘ইহা ইংরাজের একান্ত অন্যায়, অপরিসীম অবিচার, পৈশাচিক অত্যাচার; সুতা ও কাপড়ের কর অবিলম্বে চাই, এখনই চাই; নহিলে দেশ এই দন্ডেই উৎসন্নে যাইবে’।

আশ্চর্য! আমরা এরূপ আশ্চর্য আন্দোলন ও অভিমত খুব কমই দেখিয়াছি। ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী লোক, সর্ববিষয়ে স্বতন্ত্র পথানুসারী সংবাদপত্র, এ সম্বন্ধে সকলেরই এক রায়—‘কাপড় সুতার কর না বসিলে ভারতভূমি অচিরাৎ অধঃপাতে যাইবে’। ঘোরতর কংগ্রেস-বাদী ‘বেঙ্গলী’ হইতে কংগ্রেসের বিকট বিদ্বেষী ‘বঙ্গবাসী’ পর্যন্ত উভয় শ্রেণীর স্বদেশভক্তই, এ ক্ষেত্রে একাসনে উপবিষ্ট! তৈলে জলে দুগ্ধ শর্করাবৎ সংমিশ্রণ! অর্থনৈতিক সমস্যায় এরূপ অস্বাভাবিক একাকার আমরা আর কখনো দেখি নাই। এরূপ প্রকান্ড প্রমাদও আর কখনো দেখি নাই।

আন্দোলনের তুফান উঠিল। কয়েক মাস ধরিয়া আরজি ও আবেদনের ফুটকড়াই ছুটিল। সহস্র সহস্র স্বাক্ষরপূর্ণ সুদীর্ঘ আবেদন বিলাতে প্রেরিত হইল। স্বাক্ষর গ্রহণের সীমা ছিল না; দিগ্‌বিদিগ্‌বিচার ছিল না; অজ্ঞানে সজ্ঞানে যেমনই হউক দস্তখত হইলেই হইল। দস্তখত সংগ্রহের জন্য দস্তরমতো কমিশন কবুল করিয়া লোক নিযুক্ত হইয়াছিল। শুনিয়াছি কোনো পেট্রিয়ট তাঁহার অপিসের পবিত্র প্রকোষ্ঠে বসিয়া এই সৎকার্য সম্পাদন করিয়াছিলেন!

ব্রিটিশ সিংহ আন্দোলন গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্যই করুন, একান্ত উপেক্ষা করেন না; দৃশ্যত উপেক্ষার ভাব দেখাইলেও তাহাতে করিয়া অন্তরে অন্তরে তিনি একটু উত্তেজিত হইয়া থাকেন; ঈষৎ মাত্রায় আশঙ্কিতও না হইয়া থাকেন এমন নহে। মৌলিক হউক বা মেকিই হউক ‘পাবলিক ওপিনিয়ন, নামক পদার্থমাত্রই অবিকৃত বিলাতি ধাতুতে ‘সূচিকাভরণ’স্বরূপ। এ লক্ষণ সাধারণত সুলক্ষণ


১) মি. ওয়েস্টল্যান্ডের ইন্ডিয়া কাউন্সিলের বক্তৃতা : ১৭ ডিসেম্বর ১৮৯৪।