আবদারের আইন
বেশিই হইবে। কারণ আকাঙ্ক্ষিত আমদানি-করের অনুকম্পায় সে কাপড়ের সুতার উপরেও এক্সাইস শুল্ক বসিয়াছে। এক্সাইস শুল্ক না বসিলেও সম্ভবত তাহা বিলাতি কাপড়ের সহিত প্রতিযোগিতা করিতে সমর্থ হইত না। পরন্তু দেশী কলে কাপড় অপেক্ষাকৃত অতি অল্পই জন্মে, আর সে কাপড় এত অধিক মোটা যে এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তাহা সর্বদা ব্যবহারেরও যোগ্য নহে। আমরা প্রত্যক্ষ ঘটনা ও সংসারের প্রতিদৈনিক সম্ভবনাকেই সন্মুখে রাখিয়া এই কথাগুলি বলিতেছি। উদ্ভট ‘অঘটনপটিয়স’ পেট্রিয়টিজমের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র বটে। সে কথায় বড়ো বড়ো বক্তৃতা ও লম্বা-চওড়া প্রবন্ধ প্রস্তুতই হইতে পারে; সংসারের আর কোনো কার্যই তদ্দ্বারা হয় না; বিশেষত উদরের অন্ন ও অঙ্গের আবরণের সহিত তাহার আকাশ-পাতাল অপেক্ষাও সুদূর সম্বন্ধে। তবেই এখন দেখা যাইতেছে যে, আমদানিকারীদের অনর্থক আবদারে বস্ত্রাদির উপর আমদানি-কর বসিয়া আমাদের ইতঃভ্রষ্টস্ততোনষ্ট হইয়াছে। বিলাতি বস্ত্র মহার্ঘ হইল, বোম্বাই কলের কাপড়ের মূল্য বাড়িল; পরন্তু দেশী কাপড়ও অগ্নিমূল্য হইল। অতএব এই আমদানি শুল্কে দেশটা রাতারাতি উন্নতির ঊর্ধ্বমর্গে দশ যোজন ঠেলিয়া উঠিয়াছে, পাপমুখে এ কথা কীরূপে বলিব?

বলিবে আর যত কিছু না হউক মাঞ্চিস্টার বস্ত্রবণিকের তো অনিষ্ট হইল। তা বটে! কিন্তু প্রথম জিঞ্জাস্য মাঞ্চিস্টারের অনিষ্ট চেষ্টা করা পুরাতন নীতিশাস্ত্রানুসারে অন্যায়; কিন্তু ইষ্ট না থাকা সত্ত্বেও পরের অনিষ্ট করাকে কী বলিবে? দ্বিতীয় জিঞ্জাস্য মাঞ্চিস্টারের সবিশেষ অনিষ্টই বা হইবে কেন? তাহার দশ জোড়া কাপড় যেখানে বিক্রয় হইত, সেখানে না-হয় এখন ছয় জোড়া বিক্রয় হইবে; ইহার অধিক তো আর কিছু নয়! কিন্তু তাহার অবশিষ্ট ও অবিকৃত সেই চারি জোড়া কাপড় যাহারা কিনিয়া এত দিন পারিতে পারিত, তাহারা অতঃপর যে একেবারেই কাপড় পরিতে পারিবে না; এই মাঘের শীতে ‘জানু ভানু কৃষাণু’ ব্যতীত অনন্যোপায় হইবে, সে অনিষ্ট কাহার? মাঞ্চিস্টারের অথবা তুমি যে দেশের ভক্ত বলিয়া ভড়ং দেখাইয়া থাক, সেই দেশেরই? তৃতীয় প্রশ্ন, প্রকৃত প্রস্তাবে মাঞ্চিস্টারের অপরাধেই বা কী যে, তাহার পশ্চাতে লাগিয়াছিল? স্বদেশের প্রাচীন সভ্যতা আমাদের স্বতঃশিরোধার্য, কিন্তু তাহার অযথার্থতা মহিমা কীর্তন করাকে আমরা তাহার প্রকৃত মর্যাদাটিকে মাটি করাই মনে করি। তুমি বড়ায়ের বোকামি করিয়া আর্যামির যতই অতিরিক্ত আস্পরধা কর-না কেন, ইহা সকলেই জানে যে, সে কালের চরকার আমলে দেশের অদরিদ্রদের মধ্যেও অতি অল্প লোকে দুইখানা বস্ত্র একত্রে ব্যবহার করিতে পাইত। দরিদ্র শ্রেণীর বস্ত্র-পরিধান –বিলাসের কথা এখানে না বলাই ভালো। ব্রাক্ষ্মণ-ঠাকুরানীরাও তখন চরকা কাটিতেন। অন্যূন চারিমাস চরকা না ঘুরাইলে একখানা কাপড়ের উপযুক্ত সুতার সংস্থান হইত না। ইহাতেই বুঝিতে হইবে বস্ত্রের সুবিধাটি তখন কেমন ছিল। তোমার সাত গাঁটের বস্ত্র সওদাগরি ও ঢাকাই মসলিন মসলন্দের কথা শুনিবা মাত্রই আমরা মোহিত হইয়া ‘মরি মরি’ বলিলেও বলিতে পারি। কিন্তু সে ‘মরি মরিতে’ আসল ঘটনা মারা যাইবে না। তখন সমগ্র দেশমধ্যে বস্ত্রের অভাব বিলক্ষণই ছিল। মাঞ্চিস্টারের অপরাধ এই যে, সে এ দেশে বহু পরিমাণে বস্ত্র আমদানি করিয়াছিল এবং করিতেছে। সুলভ বস্ত্র আনিয়া দেশের ইতর ভদ্র সর্বসাধারণকে বস্ত্র পরাইয়াছে। সে সূক্ষ্ম সূত্র পাঠাইয়া তোমর বাবুগিরি বজায় রাখিয়াছি; বরং বিলক্ষণ বৃদ্ধিই করিয়াছে। পরন্তু, তাহারাই জন্য দেশীয় তাঁতির তাঁত আজও চলিয়াছে। মাঞ্চিস্টারের অপরাধ এই। এই অপরাধে এত রাগ? তুমি আরও রাগিয়া বলিবে, ‘অপরাধ অবশ্যই অপরিসীম অপরাধ। তাহারই জন্য তো এ-দেশীয় তাঁতিকুল উৎসন্নে গিয়াছে’। এইরূপ উক্তির ধুয়াটা কিছুকাল হইতে খুব অতিরিক্ত মাত্রায় উঠিয়াছে বটে; কিন্তু, প্রিয় মহাশয়, আপনার এ কথাটা সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। কেন স্বীকার করা যায় না তাহা বুঝাইবার স্থান এখানে নাই; কিছু সবুর করিলে বুঝাইতে পারি। কিন্তু, তাহা স্বীকার করিলেই বা কী? স্বীকারই না-হয় করলাম মাঞ্চিস্টারের সুলভ বস্ত্রের দৌরাত্ম্যে দেশের তাঁতিদের তাঁতবোনার ব্যাঘাত হইয়াছে; তাহাদের অন্ন মারা গিয়াছে; তাহারা উৎসন্ন হইতেছে। কিন্তু মাঞ্চিস্টারের এই অনিষ্ট, অনিষ্টই যদি ইহা হয়—আমাদের তাঁতিরা কি উৎসন্নের পথ হইতে ফিরিতে পারিবে? আমরা উপরেই দেখাইয়াছি, মহাশয়রা অনর্থক আন্দোলনে যাহা করিলেন, তাহাতে আমাদের তাঁতিদের তাঁতিকুল ও বৈষ্ণবকুল দুই কুলই বরং গেল।