প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
এমন-কি, জনসাধারণ-নামক বিরাট বিহঙ্গমের মুণ্ডটাই সব প্রথমে চক্ষুদ্বারা ঠুকিয়া ঠুকিয়া ডিম্ব বিদারণ করিয়া আলোকপথে দেখা দেয়, পুচ্ছ অংশ পরে বাহির হইয়া পড়ে। আমরা এখন সেই অবস্থায় আছি। জনসাধারণের মুণ্ড যাঁহারা তাঁহারাই সম্প্রতি বহুকলরবসহকারে প্রকাশমান, তাঁহাদেরই চঞ্চুযুগল মুক্তিপথের কঠিন আবরণ-অপসারণে প্রবৃত্ত, অবশিষ্ট অংশ এখনো বাধাদ্বারা গুপ্ত। মুখুজ্জেমহাশয়েরা যে সেই পুচ্ছের মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছেন তাহা না হইতে পারে। তাঁহারা জনসাধারণ নহেন, তাঁহারা বিশিষ্টসাধারণ; মাটিতে তাঁহাদের বাসা নহে, উচ্চ শাখায় তাঁহাদের নীড়; কিন্তু তাঁহারা যতই মহৎ হউন-না কেন, জনসাধারণের মুখপাত্র নহেন।
অবশ্য, এ কথা স্বীকার করিতেই হয়, যাঁহার হস্তে ক্ষমতা অধিক অনেক লোক তাঁহার অনুবর্তী হইয়া থাকে। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে এবং দেশাচারে ক্ষমতা এমনি খন্ড খন্ড বিভাগ করিয়া দিয়াছে যে, যত বড়োই লোক হউন, তাঁহার ক্ষমতা পদে পদে সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশে জমিদার জমিদারমাত্র। তিনি জুলুম করিয়া খাজনা আদায় করিতে পারেন, কিন্তু সমাজে তাঁহার অধিক অধিকার নাই। তাঁহারই একজন দীন প্রজা সমাজে হয়তো তাঁহা অপেক্ষা প্রতাপশালী। এইজন্য জাতি ও সমাজ লইয়া রাজা-মহারাজাকেও হিম্সিম্ খাইতে হয়।
ইংলন্ডে ইহা সম্ভবপর নহে। একজন ইংরাজ বড়ো জমিদার তাঁহার কোনো দীন প্রজা অপেক্ষা সমাজে খাটো হইতে পারেন না। তাঁহার ধনসম্পদ ও ক্ষমতা সমাজে তাঁহাকে উচ্চাসন দেয়। তাঁহার অধীনস্থ কোনো ফার্মার (বাংলার জোতদারের সমতুল্য ব্যক্তি) সোসাইটিতে তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারে না। অতএব সে স্থলে একজন ইংরাজ বড়ো জমিদার প্রজাদের নিকট হইতে সর্বতোভাবে মর্যাদালাভ করিতে পারেন।
কেবল তাহাই নহে। ইংলন্ডে উপাধিধারী প্রাচীন জমিদারবংশ আছে। শুনা যায়, এই-সকল প্রাচীন উপাধিধারীর প্রতি মুগ্ধভাব ইংরাজ জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। তাহার কারণ, এই-সকল লর্ড্ প্রভৃতি উপাধির সহিত অধিনায়কতার ভাব দেশের লোকের মনে বদ্ধমূল। পূর্ব-ইতিহাসে যুদ্ধবিগ্রহ শান্তিস্থাপন এবং সর্বপ্রকার সাধারণকার্যের নেতৃত্বে ইঁহারাই এক কালে প্রধান ছিলেন। এখন যদিচ ইঁহাদের কার্যকারিতা হ্রাস হইয়া ইঁহারা অনেকটা অলংকারের কাজ করিতেছেন, তথাপি কালপরম্পরাগত সেই সম্মানপ্রবাহ তাঁহাদিগকে সমাজের অগ্রভাগে বহন করিয়া রাখিয়াছে।
আমাদের দেশে তাহার অনুরূপ আদর্শ ব্রাহ্মণমণ্ডলী। কিন্তু ভ্রান্ত উপমা খাটাইয়া আমাদের জমিদারবর্গ আপনাদিগকে ইংলন্ডের সেই লর্ড্শ্রেণীর সহিত তুলনীয় জ্ঞান করেন, এবং তাঁহাদের ভাবভঙ্গি অনুকরণেরও চেষ্টা করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, আমরা অ্যারিস্টক্র্যাট্স্।
অ্যারিস্টক্র্যাট্ শব্দের বাংলাই পাওয়া যায় না। প্রাচীন ‘অভিজাত’ শব্দ বাংলাদেশে অপরিচিত। ‘কুলীন’ শব্দ সর্বজনবিদিত। কিন্তু কৌলীন্য বিলাতিভাবের অ্যারিস্টক্র্যাসি নহে।
আমাদের দেশে ধনের সম্মান য়ুরোপের ন্যায় তেমন অধিক নহে। এমন-কি, যে-সকল জাতির মধ্যে ধনী মহাজন বিস্তর আছে তাহারা সমাজে উচ্চ স্থান লাভ করিতে পারে নাই।
আমাদের দেশে রাজা-রায়বাহাদুরদের দেখিয়াও লোকে অত্যন্ত অভিভূত হইয়া পড়ে না। তাহার একটা কারণ এই যে, এই-সকল পদবী-দ্বারা উপাধিধারিগণ সমাজে এক ইঞ্চি উপরে উঠিতে পারেন না। বিবাহ প্রভৃতি ব্যাপারে যাহাদের সহিত তাঁহাদের আদানপ্রদান চলে তাহাদের কেহ হয়তো যাত্রার দলে বেহালা বাজায়— এমন-কি, কেহ হয়তো কন্গ্রেসের উপাধিহীন প্রতিনিধি। ইংলন্ডীয় সমাজে যাঁহারা উপরকার দশজনা বলিয়া বিখ্যাত নীচেকার দশ লক্ষের সহিত তাঁহাদের ব্যবধান দুর্গম। এইজন্য সেই দশ