প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
আবার রাজা-রায়বাহাদুর-বংশের শাখা-প্রশাখা আত্মীয়-কুটুম্ব ভাগিনেয়-ভ্রাতুষ্পুত্র খুড়তুত-মাসতুত ভাইরা মিলিয়া উক্ত বংশকে বংশমর্যাদার বহুদূর বাহিরে ব্যাপ্ত বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। বটের উচ্চ শাখা যেমন তাহার নিম্নগামী অসংখ্য ঝোরাকে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারে না, যতই অদ্ভুত এবং যতই গুরুতর হউক তাহাদিগকে রাত্রিদিন ঘনিষ্ঠভাবে বহন করিতে থাকে, তেমনি আমাদের দেশে নিম্নগামী দূরতম এবং দীনতম কুটুম্বস্বজনকেও ত্যাগ করিবার জো নাই; যদি-বা তাহাদিগকে অন্ন হইতে বঞ্চিত করা যায় তথাপি সর্বপ্রকার ক্রিয়াকর্মে লৌকিকাচারে তাহাদের স্পর্শক্রামকতা হইতে আপন আভিজাত্যকে বাঁচাইয়া চলিবার কোনো উপায় নাই। এইরূপে উচ্চ পদবী বাহিরকে ভিতর হইতে এবং ভিতরকে বাহির হইতে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে না। সাধারণ এবং অসাধারণের মাঝখানে মায়াগন্ডি কিছুতেই টিকে না।
আমাদের দেশে কঠিন জাতিভেদ যেমন এক দিকে ভিন্ন বর্ণের মধ্যে অলঙ্ঘ্য সামাজিক ব্যবধান স্থাপন করিয়াছে তেমনি অন্য দিকে ধনী দরিদ্র, উচ্চ নীচ, রাজটিকা-লাঞ্ছিত ও খেতাববঞ্চিতদিগকে সমান করিয়া রাখিয়াছে।
প্রাচীন বংশের একটা মোহ আছে বটে। কিন্তু বর্তমান ধনী জমিদারদের মধ্যে নাটোর প্রভৃতি দুই-এক ঘর ছাড়া প্রাচীন বংশ নাই বলিলেই হয়। আমাদের দেশে যেরূপ সম্পত্তিবিভাগ তাহাতে ধনগৌরবকে প্রাচীন করিয়া তোলা একপ্রকার অসাধ্য; দায়ভাগের শতঘ্নীপ্রহারে সে দেখিতে দেখিতে শতধাবিভক্ত হইয়া অকালে পঞ্চত্ব এমন-কি, পঞ্চাধিকত্ব প্রাপ্ত হয়।
এই তো গেল গৌরবের কথা। কিন্তু আমাদের দেশে ধনের গৌরব অদ্যাপি যথেষ্ট জাগে নাই বটে তবু তাহার প্রয়োজন যথেষ্ট আছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। অতএব যাঁহাদের হাতে ধন আছে তাঁহারা প্রয়োজনসাধন করিয়া সাধারনের আনুগত্য আকর্ষণ করিতে পারেন। তাঁহাদের পক্ষে নেতা হইবার সেই একটা সোনার রাস্তা আছে।
কিন্তু আমাদের অভিজাতগণ যাহাকে রাজপথ জ্ঞান করেন তাহা রাজা হইবার পথ। অন্য পথের শেষে দেশের কল্যাণ ও সাধারণের হৃদয় থাকিতে পারে কিন্তু খেতাবের খনি নাই, এইজন্য সে পথে বড়োলোকের জুড়িগাড়ি প্রায় দেখা যায় না। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই তাহা সকলের প্রতীত হইবে। সার আল্ফ্রেড ক্রফ্ট্ হয়তো ভালো লোক এবং বড়োলোক, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁহা অপেক্ষা অনেক বেশি ভালো লোক এবং বড়োলোক, এবং সকলের বেশি, তিনি আমাদের স্বদেশী লোক। কিন্তু ক্রফ্ট্-সাহেব ভারত ছাড়িয়া স্বদেশে গিয়াছেন, সেই শোকে বিহবল হইয়া তাঁহার স্মৃতিচিহ্ননির্মাণে ধনীগণ উৎসুক হইয়া উঠিয়াছেন; আর, বিদ্যাসাগর ইহসংসার ত্যাগ করিয়া গেলেন, দেশের ধনশালীরা কোনোপ্রকার চেষ্টা করিলেন না। ইহারা দেশের ন্যাচারাল লীডার! আমাদের স্বাভাবিক চালক! ইহারা কোন্ দিকে আমাদিগকে চালনা করিবেন? আমাদের দেশের মহোচ্চ মহদাশয়দিগের দিকে নহে, ইংরাজ মেজোসাহেব সেজোসাহেব ছোটোসাহেবের দিকে; আমাদের দীনহীন দেশের সহস্র অভাবমোচনের দিকে নহে, সাহেবের নিকুঞ্জবনে গড়ের বাদ্যের শ্রীবৃদ্ধিসাধনের দিকে। সাহেব রাজকর্মচারীরা বিলাতে চলিয়া গেলে দেশীয় ধনীগন তাঁহাদের প্রতিমা স্থাপন করিবেন ইহাতে আমরা আপত্তি করি না, কিন্তু দেশীয় পূজ্যগণের জন্যও যদি সেই পরিমানে কিছু ত্যাগস্বীকার করেন তবে দেশের নায়কত্বে তাঁহাদের কথঞ্চিৎ দাবি থাকে।
সেকালের ধনী জমিদারগণ নবাব-সরকারে প্রতিপত্তি ও পদবী-লাভের জন্য কিরূপ চেষ্টা করিতেন ও কোনো চেষ্টা করিতেন কি না, তাহা আমরা ভালোরূপ জানি না। তখন নবাব-দরবারের প্রসন্নতা হইতে কেবল শূন্যগর্ভ খেতাব ফলিত না, তখন সম্মানের মধ্যে সৌভাগ্য এবং রাজপদের মধ্যে সম্পদ পূর্ণ থাকিত; অতএব তাহা লাভের জন্য অনেকেই চেষ্টা করিতেন সন্দেহ নাই। কিন্তু তখনকার যাহা সাধারণ হিতকার্য– অর্থাৎ দিঘি-খনন, মন্দির-স্থাপন, বাঁধ-নির্মান, এই সকলকেই তাঁহারা যথার্থ কীর্তি বলিয়া