পরিশিষ্ট
রাজকুটুম্ব

‘নিয়ু ইন্ডিয়া’ ইংরাজি কাগজখানি আমরা শ্রদ্ধার সহিত পাঠ করি। ইহার রচনায় পাঠক ভুলাইবার বাঁধাবুলি ও সহজ কৌশলগুলি দেখি না। সম্পাদক যে-সমস্ত প্রবন্ধ লেখেন তাহাতে রস অথচ গাম্ভীর্য আছে, তাহাতে বলের অভাব নাই অথচ পদে পদে সংযমের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার লেখা সাময়িক সংবাদের তুচ্ছতাকে অনেক দূর ছাড়াইয়া মাথা তুলিয়া থাকে।

১২ই মার্চের পত্রে সম্পাদক ‘ভারতবর্ষে য়ুরোপীয় ক্রিমিনাল’ নাম দিয়া একটি উপাদেয় প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। বৃথা অনুবাদের চেষ্টা না করিয়া ক্রিমিনাল-শব্দটা আমরা বাংলায় গ্রহন করিতে ইচ্ছা করি।

য়ুরোপীয় ক্রিমিনালদের সম্বন্ধে কেন-যে সদ্‌বিচার হয় না, সম্পাদক বিচারকের মতো ধীরভাবে তাহার মীমাংসা করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন।

তিনি বলেন, এক পক্ষে অপরিসীম সহিষ্ণুতা ও আর-এক পক্ষে অপ্রতিহত শক্তি যেখানে সম্মুখীন হয় সেখানে স্বভাবতই এরূপ ঘটিতে বাধ্য। এ স্থলে আমরা হইলেও এমনিই করিতাম— এমন-কি, সম্পাদক টিপ্পনী দিয়া বলিয়াছেন, এশিয়াবাসী হয়তো সুযোগ পাইলে ‘রিফাইন্‌ড্’ পাশবিকতায় যুরোপীয়কে জিনিতে পারিত।

শুদ্ধমাত্র প্রসঙ্গক্রমে আমরাও একঢি মনস্তত্ত্বের কথা বলিয়া লই। সম্পাদকের এই টিপ্পনীটুকুতে একটি দুর্বলতা প্রকাশ পাইতেছে। তিনি নিজের বক্তব্যকে সবল করিবার জন্য অপক্ষপাতিতা দেখাইবার প্রলোভনটুকু সংবরণ করিতে পারেন নাই। স্বজাতির প্রতি অতিমাত্র পক্ষপাতও যেমন স্থলবিশেযে একপ্রকার কৌশলমাত্র, জাতিনির্বিশেষে একান্ত অপক্ষপাতও স্থলবিশেষে সেইরূপ কৌশল ছাড়া আর-কিছু নহে। নিয়ু ইন্ডিয়ার সম্পাদকের পক্ষে এটুকুর কোনও প্রয়োজন ছিল না কারণ, তিনি দুর্বল নহেন।

প্রাচ্যদের সম্বন্ধে ইংরাজদের কতকগুলি বাঁধিবুলি আছে, আমাদের ‘রিফাইন্‌ড্’‌ নিষ্ঠুরতা তাহার মধ্যে একটা। পূর্ব দিকটা একটা মস্ত দিক— এ দিকে যাহারাই বাস করে তাহাদের সকলকে এক নামের অধীনে এক শ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া ভূগোলবৃত্তান্ত রচনা করিলেই যে তাহারা দানা বাঁধিয়া এক হইয়া যায় তাহা নহে। বিদেশীরা সামান্য বাহ্য সাদৃশ্যের ভিতর দিয়া বৈসাদৃশ্য ধরিতে পারে না। একজন চাষার পক্ষে এক গোরার সঙ্গে আর-এক গোরার ভেদ সহজে ধরা পড়ে না— ইংরাজের অনভ্যস্ত দৃষ্টিতে একজন বাঙালিও যেমন আর-একজনও প্রায় সেইরূপ। এই কারণেই যুরোপীয়েরা সমস্ত প্রাচ্যজাতিকে একটা পিণ্ড পাকাইয়া দেখে এবং সকলের দোষগুণকে একটা নামের ঝোলার মধ্যে ভরিয়া ‘ওরিয়েন্টাল’ লেব্‌ল্‌ আঁটিয়া দেয়।

য়ুরোপীয়েরা আমাদের আধুনিক গুরু, সুতরাং তাঁহাদের কাছ হইতে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে অন্ধতাটুকুও আমরা শিখিয়াছি। রিফাইন্‌ড্‌ পাশবিকতায় এশিয়া য়ুরোপীয়ের চেয়ে অধিক বাহাদুরি কী পাইতে পারে, ইতিহাস ঘাঁটিয়া তাহার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে চাহি না। কিন্তু স্বজাতিপক্ষপাতের অপবাদটুকু শিরোধার্য করিয়া এ কথা অন্তরের সহিত, দৃঢ়বিশ্বাসের সহিত বলিতে পারি যে, হিন্দুকে অকর্মণ্য বলো, অবোধ বলো, দুর্বল বলো সহ্য করিয়া যাইব— কারণ, সহ্য করা আমাদের অভ্যাস আছে। কিন্তু হিন্দুজাতির সত্যমিথ্যা নানা অপযশের মধ্যে রিফাইন্‌ড্‌ পাশবিকতার অপবাদটা সব চেয়ে অন্যায়। আর এশিয়াটিক-নামক বন্ধনবিহীন একটা প্রকাণ্ড বিচিত্র ব্যাপারের সহিত য়ুরোপীয় বলিয়া একটি ক্ষুদ্র ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়ের পশুত্ব মনুষ্যত্ব বা দেবত্বর তুলনা একেবারেই অসংগত, অনর্থক। একটা মানকচুর সহিত একটা বাগানের তুলনা হইতেই পারে না।

এটা একটা অবান্তর কথা। মোটের উপর, সম্পাদক যে প্রবন্ধটি লিখিয়াছেন তাহার প্রশংসা করিতেই হইবে। ইহার মধ্যে চাপা কথা ঢের আছে, তাহা চাপাই থাক্‌। আমরা কেবল একঢি কথা যোগ করিতে চাই মাত্র।

যাহার হাতে শক্তি আছে সে-যে স্বসম্প্রদায়ের দিকে টানিয়া অবিচার করিবে, ইহা মানুষের স্বভাব। ইংরাজও মানুষ, তাই সে