পরিশিষ্ট
ইংরাজ-ক্রিমিনালকে সাজা দিয়া উঠিতে পারে না। যাহার হাতে শক্তি নাই সে প্রবলের অন্যায়বিচার অগত্যা সহ্য করে, ইহাও মানুষের স্বভাব। আমরাও মানুষ, তাই আমাদিগকে ইংরাজের আক্রমণ চুপ করিয়া সহ্য করিতে হয়। এই এক জায়গায় মনুষ্যত্বের সমনিম্নভূমিতে ইংরাজের সঙ্গে আমরা একত্রে মিলিতে পারিয়াছি।

নূতন ইস্কুল হইতে বাহির হইয়া যখন সাম্য স্বাধীনতা মৈত্রী প্রভৃতি বিদেশী বচনগুলি বাংলায় তর্জমা করিবার ভার আমরা গ্রহণ করিয়াছিলাম তখন আমরা এই জানিতাম যে, য়ুরোপ বাহুবলে প্রবল হইলেও মনুষ্যত্বের অধিকার সম্বন্ধে দুর্বলের সহিত আপনার সাম্য স্বীকার করেন। তখন আমরা ইস্কুলের উত্তীর্ণ ছেলেরা একেবারে অভিভূত হইয়া গিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, ইহারা দেবতা। আমরা চিরকাল ইহাদিগকে পূজা করিব এবং ইহারা চিরকাল আমাদিগকে প্রসাদ বিতরণ করিবে— ইহাদের সহিত আমাদের এই সম্বন্ধই শাশ্বত। আমরা মনের ভিতর হইতে ইহাদের কাছে সম্পূর্ণ হার মানিয়াছিলাম।

আজ যখন বুঝিতেছি ইহারা আমাদের অসমকক্ষ নহে— আমরাও দুর্বল, ইহারাও দুর্বল— আমাদের অক্ষমের দুর্বলতা, ইহাদের সক্ষমের দুর্বলতা— তখন অভিভূতির ভাব কাটিয়া গিয়া আমরা মাথা তুলিতে পারি। ইংরাজ ক্রমাগত আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছে, ‘ন্যায়পরতা প্রভৃতি সম্বন্ধে তোমাদের স্বশ্রেণীর কোনো জাতির সহিত আমাদের তুলনাই হয় না।’ এক সময়ে ইংরাজ যেন এই ধর্মশ্রেষ্ঠতার প্রেস্টিজ চালাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। যে ব্যক্তি অক্ষমের নিকট ধর্মরক্ষা করিয়া চলে তাহার কাছে হার না মানিয়া থাকা যায় না— সেকালে আমাদের মন হার মানিয়াছিল। এখন ইংরাজ প্রতাপের প্রেস্টিজ সর্বাগ্রগণ্য করিয়াছে— স্বদেশী ও এদেশীকে ধর্মের চক্ষে সমান করিবার বল ও সাহস এখন তাহার নাই— এখন ইংরাজের কাছে ইংরাজ গবর্মেন্ট্‌ দুর্বল। এখন ম্যাঞ্চেস্টার রাজা, বার্মিংহ্যাম রাজা, নীলকর রাজা, চা-কর রাজা, চেম্বর অফ কমার্স্‌ রাজা— তাই আজকাল আমাদের প্রতি ভয় দ্বেষ ঈর্ষার নানা লক্ষণ দেখিতে পাই। দেখি, এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হইতে আমরা তাড়া খাইতেছি, আপিস হইতে ভ্রষ্ট হইতেছি, ডাক্তারিশিক্ষায় বাধা পাইতেছি, বিজ্ঞানশিক্ষায় গূঢ়ভাবে প্রতিহত হইতেছি। ইহাতে আমাদের অনেক অসুবিধা আছে, কিন্তু এই সান্ত্বনাটুকু পাইতে পারি যে, কর্তারা আমাদের চেয়ে বেশি বড়ো নহে। ইঁহারা আমাদের অগ্রাহ্য করিয়া বাঁচে না— ইহাদের মনে এ আশঙ্কাটুকু আছে যে, সুযোগ পাইলে আমরা বিদ্যায় ক্ষমতায় ইহাদের সমান হইয়া উঠিতে পারি। ইংরাজ-ক্রিমিনাল দেশীয়ের প্রতি অন্যায় করিয়া ন্যায়সংগত শাস্তি পাইলে ইংরাজকে দেশীয় আপন সমতুল্য বলিয়া জ্ঞান করিবে, এই ভয়টুকু যখন ইংরাজের মনে প্রবেশ করিয়াছে, তখন তাহার আত্মসম্মান নষ্ট হইয়াছে। এই উপলক্ষে আমাদের চিত্তও ইংরাজের কাছে নতিস্বীকারের দায় হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতেছে— প্রত্যহ তাহার প্রমাণ পাইতেছি।

সম্পাদকমহাশয় বলেন, আমরা যদি ঘুষির পরিবর্তে ঘুষি ফিরাইতে পারি, তবে রাস্তায় ঘাটে ইংরাজকে অনেক অন্যায় হইতে নিরস্ত রাখিতে পারি। কথাটা সত্য— মুষ্টিযোগের মতো চিকিৎসা নাই— কিন্তু সম্পাদকের উপদেশ সহসা কেহ মানিতে রাজি হইবে না। তাহার গুটিকতক কারণ আছে।

একটি কারণ এই যে, আমরা একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হইয়াছি— পরস্পর মিলিয়া-মিশিয়া থাকিবার যত-কিছু আদেশ-উপদেশ-অনুশাসন সমস্তই শিশুকাল হইতে আমাদিগকে প্রত্যহ পালন করিতে হইয়াছে। ঘুষাঘুষি করা, বিবাদ করা, পরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা ও নিজের অধিকার লড়াই করিয়া রাখা, একান্নবর্তী পরিবারে কিছুতেই চলে না। আমাদের পরিবার ভালোমানুষ হইবার পরস্পরের অনুকূলকারী হইবার, একটি কারখানাবিশেষ। অতএব ঘুষিশিক্ষা করিলেও মানুষের নাসিকাগ্রে ও চক্ষুতারকায় তাহা নির্বিচারে প্রয়োগ করিবার ক্ষিপ্রকারিতা আমাদের অভ্যাস হয় না। নিজের অসুবিধা করিয়াও পরস্পরের সহিত মিলিবার ভাবই আমাদের স্বভাব ও অভ্যাস-সংগত— পরস্পরের সহিত লড়িবার ভাব আমাদের সমাজব্যবস্থার মধ্যে কোথাও স্ফূর্তি পাইবার স্থান পায় নাই।