অভিনয়
এই জন্যই বহুকাল হইতে লোকে বলিয়া আসিতেছে— আমরা অদৃষ্টের খেলেনা। আমাদের লইয়া সে খেলা করিতেছে। সুখের বিষয় এই যে, নিতান্ত ছেলেখেলা নয়। একটা নিয়ম আছে, একটা ফল আছে। অভিনয়ের সঙ্গে মনুষ্যজীবনের তুলনা পুরানো হইয়া গিয়াছে, কিন্তু কেবল মাত্র সেই অপরাধে সে তুলনাকে যাবজ্জীবন নির্বাসিত করা যায় না। অভিনয়ের সঙ্গে মনুষ্যজীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়। প্রত্যেক অভিনেতার অভিনয় আলাদা আলাদা করিয়া দেখিলে সকলি ছাড়া-ছাড়া বিশৃঙ্খল বলিয়া মনে হয়, একটা অর্থ পাওয়া যায় না। তেমনি প্রত্যেক মনুষ্যের জীবনলীলা সাধারণ মনুষ্যজীবন হইতে পৃথক্ করিয়া দেখিলে নিতান্ত অর্থশূন্য বলিয়া বোধ হয়, অদৃষ্টের ছেলেখেলা বলিয়া মনে হয়। কিন্তু তাহা নহে; আমরা একটা মহানাটক অভিনয় করিতেছি, প্রত্যেকের অভিনয়ে তাহার উপাখ্যানভাগ পরিপুষ্ট হইতেছে। এক এক জন অভিনেতা রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিতেছে,নিজের নিজের পালা অভিনয় করিতেছে ও নিষ্ক্রান্ত হইয়া যাইতেছে, সে জানে না তাহার ঐ জীবনাংশের অভিনয়ে সমস্ত নাটকের উপাখ্যানভাগ কিরূপে সৃজিত হইতেছে। সে নিজের অংশটুকু জানে মাত্র; সমস্তটার সহিত যোগটুকু জানে না। কাজেই সে মনে করিল, ‘আমার পালা সাঙ্গ হইল এবং সমস্তই সাঙ্গ হইল।’

প্রত্যহ যে শত সহস্র অভিনেতা, সামান্যই হউক আর মহৎই হউক, রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিতেছে ও নিষ্ক্রান্ত হইতেছে, সকলেই সেই মহা-উপাখ্যানের সহিত জড়িত, কেহ অধিক, কেহ অল্প; কেহ বা নিজের অভিনয়াংশের সহিত সাধারণ উপাখ্যানের যোগ কিয়ৎপরিমাণে জানে, কেহ বা একেবারেই জানে না। মনে কর, এই মহা নাটকের “ফরাসীবিপ্লব”-নামক একটা গর্ভাঙ্ক অভিনয় হইয়া গেল, কত শত বৎসর ধরিয়া কত শত রাজা হইতে কত শত দীনতম ব্যক্তি না জানিয়া না শুনিয়া ইহার অভিনয় করিয়া আসিতেছে; তাহাদের প্রত্যেকের জীবন পৃথক্ করিয়া পড়িলে এক একটি প্রলাপ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু সমস্তটা একত্র করিয়া পড়িবার ক্ষমতা থাকিলে প্রকাণ্ড একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নাটক পড়া যায়। একবার কল্পনা করা যাক্‌, পৃথিবীর বহির্ভাগে দেবতারা সহস্র তারকানেত্র মেলিয়া এই অভিনয় দেখিতেছেন। কি আগ্রহের সহিত তাঁহারা চাহিয়া রহিয়াছেন! প্রতি শতাব্দীর অঙ্কে অঙ্কে উপাখ্যান একটু একটু করিয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। প্রতি দৃশ্যপরিবর্তনে তাঁহাদের কত প্রকার কল্পনার উদয় হইতেছে, কত কি অনুমান করিতেছেন! যদি পূর্ব হইতেই এই কাব্য, এই নাটক পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলেও কি ব্যগ্রতার সহিত প্রত্যেক অভিনয়ের ফল দেখিবার জন্য উৎসুক রহিয়াছেন! যেখানে একটা ঔৎসুক্যজনক গর্ভাঙ্ক আসন্ন হইয়াছে, সেইখানে তাঁহারা আগ্রহরুদ্ধ নিঃশ্বাসে মনে মনে বলিতে থাকেন, এইবার সেই মহা-ঘটনা ঘটিবে। কী মহান্‌ অভিনয়! কী বিচিত্র দৃশ্য! কী প্রকাণ্ড রঙ্গবেদী!