প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
নিজের গুণহীনতার বিষয়ে অনভিজ্ঞ এমন নির্গুণ শতকরা নিরেনব্বই জন, কিন্তু নিজের গুণ একেবারে জানে না এমন গুণী কোথায়? তবে, চব্বিশ ঘণ্টা নিজের গুণগুলি চোখের সাম্নে খাড়া করিয়া রাখে না এমন বিনয়ী সংসারে মেলে। অতএব কে বিনয়ী? না, যে আপনাকে ভুলিয়া থাকে, যে আপনাকে জানে না, তাহার কথা হইতেছে না।
বড়মানুষ গৃহকর্ত্তা নিমন্ত্রিতদিগকে বলেন, “মহাশয়, দরিদ্রের কুটীরে পদার্পণ করিয়াছেন; আপনাদিগকে আজ বড় কষ্ট দেওয়া হইল” ইত্যাদি। সকলে বলে, “আহা মাটির মানুষ!” কিন্তু ইহারা কি সামান্য অহংকারী! অপ্রস্তুত হইলে লোকে যে কারণে কাঁদে না, হাসে, ইহারাও সেই কারণে বিনয়বাক্য বলিয়া থাকে। ইহারা কোনমতেই ভুলিতে পারে না যে, ইহাদের বাসস্থান প্রাসাদ, কুটীর নহে। এ অহংকার সর্বদাই ইহাদের মনে জাগরূক থাকে। এই নিমিত্ত ইহাদিগকে সারাক্ষণ শশব্যস্ত হইয়া থাকিতে হয়, পাছে বিনয়ের অভাব প্রকাশ পায়। অভ্যাগত আসিলেই তাড়াতাড়ি ডাকিয়া বলিতে হয়, “মহাশয়, এ কুটীর, প্রাসাদ নহে।” তেমন বৃষ যদি কেহ থাকে তবে এই অহংকারী মশাদের বলে, “বাপু হে, তুমি যে এতক্ষণ আমার শিঙে বসিয়াছিলে, তাহা আমি মূলে জানিতেই পারি নাই, ভোঁ ভোঁ করিতে আসিয়াছ বলিয়া এতক্ষণে টের পাইলাম। তোমার এ বাড়িটা প্রাসাদ কি কুটীর, সে বিষয়ে আমি মুহূর্তের জন্য ভাবিও নাই, আমার নজরেই পড়ে নাই, অতএব ও কথা তুলিবার আবশ্যক কি?” আমাদের দেশে উক্ত প্রকার অহংকারী বিনয়ের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব। সুকণ্ঠ বলেন “আমার গলা নাই”, সুলেখক বলেন “আমি ছাই ভস্ম লিখি”, সুরূপসী বলেন “এ পোড়ামুখ লোকের কাছে দেখাইতে লজ্জা করে”! এ ভাবটা দূর হলেই ভালো হয়। ইহাতে না অহংকার ঢাকা পড়ে, না সরলতা প্রকাশ হয়! আর, এই সামান্য উপায়েই যদি বিনয় করা যাইতে পারে, তবে তো বিনয় খুব শস্তা!
আসল কথা এই যে, “বিনয়বচন” বলিয়া একটা পদার্থ মূলেই নাই। বিনয়ের মুখে কথা নাই, বিনয়ের অর্থ চুপ করিয়া থাকা। বিনয় একটা অভাবাত্মক গুণ। আমার যে অহংকারের বিষয় আছে এইটে না মনে থাকাই বিনয়, আমাকে যে বিনয় প্রকাশ করিতে হইবে এইটে মনে থাকার নাম বিনয় নহে। যে বলে ‘আমি দরিদ্র’ সে বিনয়ী নহে; যে স্বভাবতই প্রকাশ করে না যে ‘আমি ধনী’ সেই বিনয়ী। যাহার বিনয়বাক্য বলিবার আবশ্যক পড়ে না সেই বিনয়ী। তবে কি না, বিদেশী ভাষা শিখিতে হইলে ব্যাকরণ পড়িতে হয়, অভিধান মুখস্থ করিতে হয়; বিনয় যাহাদের পক্ষে বিদেশী, তাহাদিগকে বিনয়ের অভিধান মুখস্থ করিতে হয়। কিন্তু এই প্রকার মুখস্থ বিনয় সংসারের এক্জামিন পাস করিতেই কাজে দেখে, পরীক্ষাশালার বাহিরে কোনো কাজে লাগে না।