গোরা
আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে তার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্যে কেউ বা প্রেমের সৌন্দর্য-অংশকেই কবিত্বের দ্বারা উজ্জ্বল করে তুলে তার মন্দটাকে লজ্জা দেয়, আর কেউ বা ওর মন্দটাকেই বড়ো করে তুলে কামিনীকাঞ্চনত্যাগের বিধান দিয়ে থাকে; ও দুটো কেবল দুই ভিন্ন প্রকৃতির লোকের ভিন্নরকম প্রণালী। একটাকেই যদি নিন্দে কর তবে অন্যটাকেও রেয়াত করলে চলবে না।”

গোরা। নাঃ, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলুম। তোমার অবস্থা তেমন খারাপ হয় নি। এখনো যখন ফিলজফি তোমার মাথায় খেলছে তখন নির্ভয়ে তুমি ‘লাভ’ করতে পারো, কিন্তু সময় থাকতে নিজেকে সামলে নিয়ো— হিতৈষী বন্ধুদের এই অনুরোধ।

বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আঃ, তুমি কি পাগল হয়েছ! আমার আবার ‘লাভ’। তবে এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, পরেশবাবুদের আমি যেটুকু দেখেছি এবং ওঁদের সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে ওঁদের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হয়েছে। বোধ করি তাই ওঁদের ঘরের ভিতরকার জীবনযাত্রাটা কী রকম সেটা জানবার জন্যে আমার একটা আকর্ষণ হয়েছিল।”

গোরা। উত্তম কথা, সেই আকর্ষণটাই সামলে চলতে হবে। ওঁদের সম্বন্ধে প্রাণিবৃত্তান্তের অধ্যায়টা নাহয় অনাবিষ্কৃতই রইল। বিশেষত ওঁরা হলেন শিকারী প্রাণী, ওঁদের ভিতরকার ব্যাপার জানতে গিয়ে শেষকালে এত দূর পর্যন্ত ভিতরে যেতে পার যে তোমার টিকিটি পর্যন্ত দেখবার জো থাকবে না।

বিনয়। দেখো, তোমার একটা দোষ আছে। তুমি মনে কর যত কিছু শক্তি ঈশ্বর কেবল একলা তোমাকেই দিয়েছেন, আর আমরা সবাই দুর্বল প্রাণী।

কথাটা গোরাকে হঠাৎ যেন নূতন করিয়া ঠেকিল; সে উৎসাহবেগে বিনয়ের পিঠে এক চাপড় মারিয়া কহিল, “ঠিক বলেছ— ঐটে আমার দোষ— আমার মস্ত দোষ।”

বিনয়। উঃ, ওর চেয়েও তোমার আর-একটা মস্ত দোষ আছে। অন্য লোকের শিরদাঁড়ার উপরে কতটা আঘাত সয় তার ওজনবোধ তোমার একেবারেই নেই।

এমন সময় গোরার বড়ো বৈমাত্র ভাই মহিম তাঁহার পরিপুষ্ট শরীর লইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরা!”

গোরা তাড়াতাড়ি চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আজ্ঞে!”

মহিম। দেখতে এলেম বর্ষার জলধরপটল আমাদের ছাদের উপরে গর্জন করতে নেমেছে কি না। আজ ব্যাপারখানা কী? ইংরেজকে বুঝি এতক্ষণে ভারত-সমুদ্রের অর্ধেকটা পথ পার করে দিয়েছ? ইংরেজের বিশেষ কোনো লোকসান দেখছি নে, কিন্তু নীচের ঘরে মাথা ধরে বড়োবউ পড়ে আছে, সিংহনাদে তারই যা অসুবিধে হচ্ছে।

এই বলিয়া মহিম নীচে চলিয়া গেলেন।

গোরা লজ্জা পাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল— লজ্জার সঙ্গে ভিতরে একটু রাগও জ্বলিতে লাগিল, তাহা নিজের বা অন্যের ’পরে ঠিক বলা যায় না। একটু পরে সে ধীরে ধীরে যেন আপন মনে কহিল, ‘সব বিষয়েই, যতটা দরকার আমি তার চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়ে ফেলি, সেটা যে অন্যের পক্ষে কতটা অসহ্য তা আমার ঠিক মনে থাকে না।’

বিনয় গৌরের কাছে আসিয়া সস্নেহে তার হাত ধরিল।