প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
গোরা ও বিনয় ছাত হইতে নামিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় গোরার মা উপরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিনয় তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল।
গোরার মা আনন্দময়ীকে দেখিলে গোরার মা বলিয়া মনে হয় না। তিনি ছিপ্ছিপে পাতলা, আঁটসাঁট; চুল যদি বা কিছু কিছু পাকিয়া থাকে বাহির হইতে দেখা যায় না; হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় তাঁহার বয়স চল্লিশেরও কম। মুখের বেড় অত্যন্ত সুকুমার, নাকের ঠোঁটের চিবুকের ললাটের রেখা কে যেন যত্নে কুঁদিয়া কাটিয়াছে; শরীরের সমস্তই বাহুল্যবর্জিত। মুখে একটি পরিষ্কার ও সতেজ বুদ্ধির ভাব সর্বদাই প্রকাশ পাইতেছে। রঙ শ্যামবর্ণ, গোরার রঙের সঙ্গে তাহার কোনোই তুলনা হয় না। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই একটা জিনিস সকলের চোখে পড়ে— তিনি শাড়ির সঙ্গে শেমিজ পরিয়া থাকেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনকার দিনে মেয়েদের জামা বা শেমিজ পরা যদিও নব্যদলে প্রচলিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে তবু প্রবীণা গৃহিণীরা তাহাকে নিতান্তই খৃস্টানি বলিয়া অগ্রাহ্য করিতেন। আনন্দময়ীর স্বামী কৃষ্ণদয়ালবাবু কমিসেরিয়েটে কাজ করিতেন, আনন্দময়ী তাঁহার সঙ্গে ছেলেবেলা হইতে পশ্চিমে কাটাইয়াছেন, তাই ভালো করিয়া গা ঢাকিয়া গায়ে কাপড় দেওয়া যে লজ্জা বা পরিহাসের বিষয় এ সংস্কার তাঁহার মনে স্থান পায় নাই। ঘরদুয়ার মাজিয়া ঘষিয়া, ধুইয়া মুছিয়া, রাঁধিয়া বাড়িয়া, সেলাই করিয়া, গুনতি করিয়া, হিসাব করিয়া, ঝাড়িয়া, রৌদ্রে দিয়া, আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীর খবর লইয়া, তবু তাঁহার সময় যেন ফুরাইতে চাহে না। শরীরে অসুখ করিলে তিনি কোনোমতেই তাহাকে আমল দিতে চান না— বলেন, “অসুখে তো আমার কিছু হবে না, কাজ না করতে পেলে বাঁচব কী করে?”
গোরার মা উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরার গলা যখনই নীচে থেকে শোনা যায় তখনই বুঝতে পারি বিনু নিশ্চয়ই এসেছে। ক’দিন বাড়ি একেবারে চুপচাপ ছিল— কী হয়েছে বল্ তো বাছা? আসিস নি কেন, অসুখবিসুখ করে নি তো?”
বিনয় কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, “না, মা, অসুখ না— যে বৃষ্টিবাদল!”
গোরা কহিল, “তাই বৈকি! এর পরে বৃষ্টিবাদল যখন ধরে যাবে তখন বিনয় বলবেন, যে রোদ পড়েছে! দেবতার উপর দোষ দিলে দেবতা তো কোনো জবাব করেন না— আসল মনের কথা অন্তর্যামীই জানেন।”
বিনয় কহিল, “গোরা, তুমি কী বাজে বকছ!”
আনন্দময়ী কহিলেন, “তা সত্যি বাছা, অমন করে বলতে নেই। মানুষের মন কখনো ভালো থাকে কখনো মন্দ থাকে, সব সময় কি সমান যায়! তা নিয়ে কথা পাড়তে গেলে উৎপাত করা হয়। তা আয় বিনু, আমার ঘরে আয়, তোর জন্যে খাবার ঠিক করেছি।”
গোরা জোর করিয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, “না মা, সে হচ্ছে না, তোমার ঘরে আমি বিনয়কে খেতে দেব না।”
আনন্দময়ী। ইস্, তাই তো! কেন বাপু, তোকে তো আমি কোনোদিন খেতে বলি নে— এ দিকে তোর বাপ তো ভয়ংকর শুদ্ধাচারী হয়ে উঠেছেন— স্বপাক না হলে খান না। বিনু আমার লক্ষ্মী ছেলে, তোর মতো ওর গোঁড়ামি নেই, তুই কেবল ওকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখতে চাস।
গোরা। সে কথা ঠিক, আমি জোর করেই ওকে ঠেকিয়ে রাখব। তোমার ঐ খৃস্টান দাসী লছমিয়াটাকে না বিদায় করে দিলে তোমার ঘরে খাওয়া চলবে না।
আনন্দময়ী। ওরে গোরা, অমন কথা তুই মুখে আনিস নে। চিরদিন ওর হাতে তুই খেয়েছিস— ও তোকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছে। এই সেদিন পর্যন্ত ওর হাতের তৈরি চাটনি না হলে তোর যে খাওয়া রুচত না। ছোটোবেলায় তোর যখন বসন্ত