গোরা
হয়েছিল লছমিয়া যে করে তোকে সেবা করে বাঁচিয়েছে সে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।

গোরা। ওকে পেনসন দাও, জমি কিনে দাও, ঘর কিনে দাও, যা খুশি করো, কিন্তু ওকে রাখা চলবে না মা।

আনন্দময়ী। গোরা, তুই মনে করিস টাকা দিলেই সব ঋণ শোধ হয়ে যায়! ও জমিও চায় না, বাড়িও চায় না, তোকে না দেখতে পেলে ও মরে যাবে।

গোরা। তবে তোমার খুশি ওকে রাখো। কিন্তু বিনু তোমার ঘরে খেতে পাবে না। যা নিয়ম তা মানতেই হবে, কিছুতেই তার অন্যথা হতে পারে না। মা, তুমি এতবড়ো অধ্যাপকের বংশের মেয়ে, তুমি যে আচার পালন করে চল না এ কিন্তু —

আনন্দময়ী। ওগো, তোমার মা আগে আচার পালন করেই চলত; তাই নিয়ে অনেক চোখের জল ফেলতে হয়েছে— তখন তুমি ছিলে কোথায়? রোজ শিব গড়ে পুজো করতে বসতুম আর তোমার বাবা এসে টান মেরে ফেলে ফেলে দিতেন। তখন অপরিচিত বামুনের হাতেও ভাত খেতে আমার ঘেন্না করত। সেকালে রেলগাড়ি বেশিদূর ছিল না— গোরুর গাড়িতে, ডাকগাড়িতে, পালকিতে, উটের উপর চড়ে কতদিন ধরে কত উপোস করে কাটিয়েছি। তোমার বাবা কি সহজে আমার আচার ভাঙতে পেরেছিলেন? তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর সায়েব-মনিবরা তাঁকে বাহবা দিত, তাঁর মাইনেই বেড়ে গেল— ঐজন্যেই তাঁকে এক জায়গায় অনেক দিন রেখে দিত— প্রায় নড়াতে চাইত না। এখন তো বুড়োবয়সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাশ রাশ টাকা নিয়ে তিনি হঠাৎ উলটে খুব শুচি হয়ে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু আমি তা পারব না। আমার সাত পুরুষের সংস্কার একটা একটা করে নির্মূল করা হয়েছে— সে কি এখন আর বললেই ফেরে?

গোরা। আচ্ছা, তোমার পূর্বপুরুষদের কথা ছেড়ে দাও— তাঁরা তো কোনো আপত্তি করতে আসছেন না। কিন্তু আমাদের খাতিরে তোমাকে কতকগুলো জিনিস মেনে চলতেই হবে। নাহয় শাস্ত্রের মান নাই রাখলে, স্নেহের মান রাখতে হবে তো।

আনন্দময়ী। ওরে, অত করে আমাকে কী বোঝাচ্ছিস। আমার মনে কী হয় সে আমিই জানি। আমার স্বামী, আমার ছেলে, আমাকে নিয়ে তাদের যদি পদে পদে কেবল বাধতে লাগল তবে আমার আর সুখ কী নিয়ে। কিন্তু তোকে কোলে নিয়েই আমি আচার ভাসিয়ে দিয়েছি তা জানিস? ছোটো ছেলেকে বুকে তুলে নিলেই বুঝতে পারা যায় যে জাত নিয়ে কেউ পৃথিবীতে জন্মায় না। সে কথা যেদিন বুঝেছি সেদিন থেকে এ কথা নিশ্চয় জেনেছি যে আমি যদি খৃস্টান বলে ছোটো জাত বলে কাউকে ঘৃণা করি তবে ঈশ্বর তোকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন। তুই আমার কোল ভরে আমার ঘর আলো করে থাক্‌, আমি পৃথিবীর সকল জাতের হাতেই জল খাব।

আজ আনন্দময়ীর কথা শুনিয়া বিনয়ের মনে হঠাৎ কী-একটা অস্পষ্ট সংশয়ের আভাস দেখা দিল। সে একবার আনন্দময়ীর ও একবার গোরার মুখের দিকে তাকাইল, কিন্তু তখনই মন হইতে সকল তর্কের উপক্রম দূর করিয়া দিল।

গোরা কহিল, “মা, তোমার যুক্তিটা ভালো বোঝা গেল না। যারা বিচার করে শাস্ত্র মেনে চলে তাদের ঘরেও তো ছেলে বেঁচে থাকে, আর ঈশ্বর তোমার সম্বন্ধেই বিশেষ আইন খাটাবেন, এ বুদ্ধি তোমাকে কে দিলে?”

আনন্দময়ী। যিনি তোকে দিয়েছেন বুদ্ধিও তিনি দিয়েছেন। তা আমি কী করব বল্‌? আমার এতে কোনো হাত নেই। কিন্তু ওরে পাগল, তোর পাগলামি দেখে আমি হাসব কি কাঁদব তা ভেবে পাই নে। যাক্‌, সে-সব কথা যাক। তবে বিনয় আমার ঘরে খাবে না?

গোরা। ও তো এখনই সুযোগ পেলেই ছোটে, লোভটি ওর ষোলো-আনা। কিন্তু মা, আমি যেতে দেব না। ও যে বামুনের ছেলে, দুটো মিষ্টি দিয়ে সে কথা ওকে ভোলালে চলবে না। ওকে অনেক ত্যাগ করতে হবে, প্রবৃত্তি সামলাতে হবে, তবে ও জন্মের গৌরব রাখতে পারবে। মা, তুমি কিন্তু রাগ কোরো না। আমি তোমার পায়ের ধুলো নিচ্ছি।