গোরা

আনন্দময়ী। আমি রাগ করব! তুই বলিস কী! তুই যা করছিস এ তুই জ্ঞানে করছিস নে, তা আমি তোকে বলে দিলুম। আমার মনে এই কষ্ট রইল যে তোকে মানুষ করলুম বটে, কিন্তু— যাই হোক গে, তুই যাকে ধর্ম বলে বেড়াস সে আমার মানা চলবে না— নাহয়, তুই আমার ঘরে আমার হাতে নাই খেলি— কিন্তু তোকে তো দু’সন্ধে দেখতে পাব, সেই আমার ঢের। বিনয়, তুমি মুখটি অমন মলিন কোরো না বাপ— তোমার মনটি নরম, তুমি ভাবছ আমি দুঃখ পেলুম— কিছু না বাপ। আর-এক দিন নিমন্ত্রণ করে খুব ভালো বামুনের হাতেই তোমাকে খাইয়ে দেব— তার ভাবনা কী! আমি কিন্তু, বাছা, লছমিয়ার হাতে জল খাব, সে আমি সবাইকে বলে রাখছি।

গোরার মা নীচে চলিয়া গেলেন। বিনয় চুপ করিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার পর ধীরে ধীরে কহিল, “গোরা, এটা যেন একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

গোরা। কার বাড়াবাড়ি?

বিনয়। তোমার।

গোরা। এক চুল বাড়াবাড়ি নয়। যেখানে যার সীমা আমি সেইটে ঠিক রক্ষে করে চলতে চাই। কোনো ছুতোয় সূচ্যগ্রভূমি ছাড়তে আরম্ভ করলে শেষকালে কিছুই বাকি থাকে না।

বিনয়। কিন্তু মা যে।

গোরা। মা কাকে বলে সে আমি জানি। আমাকে কি সে আবার মনে করিয়ে দিতে হবে! আমার মা’র মতো মা ক’জনের আছে। কিন্তু আচার যদি না মানতে শুরু করি তবে একদিন হয়তো মাকেও মানব না। দেখো বিনয়, তোমাকে একটা কথা বলি, মনে রেখো— হৃদয় জিনিসটা অতি উত্তম, কিন্তু সকলের চেয়ে উত্তম নয়।

বিনয় কিছুক্ষণ পরে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, “দেখো, গোরা, আজ মা’র কথা শুনে আমার মনের ভিতরে কী রকম একটা নাড়াচাড়া হচ্ছে! আমার বোধ হচ্ছে যেন মা’র মনে কী একটা কথা আছে, সেইটে তিনি আমাদের বোঝাতে পারছেন না, তাই কষ্ট পাচ্ছেন।”

গোরা অধীর হইয়া কহিল, “আঃ বিনয়, অত কল্পনা নিয়ে খেলিয়ো না— ওতে কেবলই সময় নষ্ট হয়, আর কোনো ফল হয় না।”

বিনয়। তুমি পৃথিবীর কোনো জিনিসের দিকে কখনো ভালো করে তাকাও না, তাই যেটা তোমার নজরে পড়ে না, সেটাকেই তুমি কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে চাও। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, আমি কতবার দেখেছি মা যেন কিসের জন্যে একটা ভাবনা পুষে রেখেছেন— কী যেন একটা ঠিকমত মিলিয়ে দিতে পারছেন না— সেইজন্যে ওঁর ঘরকরনার ভিতরে একটা দুঃখ আছে। গোরা, তুমি ওঁর কথাগুলো একটু কান পেতে শুনো।

গোরা। কান পেতে যতটা শোনা যায় তা আমি শুনে থাকি— তার চেয়ে বেশি শোনবার চেষ্টা করলে ভুল শোনবার সম্ভাবনা আছে বলে সে চেষ্টাই করি নে।