গোরা
তাহার নিতান্ত গোঁড়ামি; কিন্তু পূর্বের কথাবার্তায় গোরা নাকি জানিয়াছে যে বিনয় পরেশবাবুর বাড়িতে যাওয়া-আসা করে না, আজ সহসা তাহার মনে হইতে পারে যে, সে কথাটা সত্য নয়। বিশেষত বরদাসুন্দরী তাহাকে বিশেষ করিয়া ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন, সেখানে তাঁহার মেয়েদের সঙ্গে তাহার আলাপ হইতে লাগিল— গোরার তীক্ষ্ম লক্ষ হইতে ইহা এড়াইয়া যায় নাই। মেয়েদের সঙ্গে এইরূপ মেলামেশায় ও বরদাসুন্দরীর আত্মীয়তায় মনে মনে বিনয় ভারি একটা গৌরব ও আনন্দ অনুভব করিতেছিল— কিন্তু সেইসঙ্গে এই পরিবারে গোরার সঙ্গে তাহার আদরের পার্থক্য তাহাকে ভিতরে ভিতরে বাজিতেছিল। আজ পর্যন্ত এই দুটি সহপাঠীর নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝখানে কেহই বাধাস্বরূপ দাঁড়ায় নাই। একবার কেবল গোরার ব্রাহ্মসামাজিক উৎসাহে উভয়ের বন্ধুত্বে একটা ক্ষণিক আচ্ছাদন পড়িয়াছিল— কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি বিনয়ের কাছে মত জিনিসটা খুব একটা বড়ো ব্যাপার নহে— সে মত লইয়া যতই লড়ালড়ি করুক-না কেন, মানুষই তাহার কাছে বেশি সত্য। এবারে তাহাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে মানুষের আড়াল পড়িবার উপক্রম হইয়াছে বলিয়া সে ভয় পাইয়াছে। পরেশের পরিবারের সহিত সম্বন্ধকে বিনয় মূল্যবান বলিয়া জ্ঞান করিতেছে, কারণ তাহার জীবনে ঠিক এমন আনন্দের আস্বাদন সে আর কখনো পায় নাই— কিন্তু গোরার বন্ধুত্ব বিনয়ের জীবনের অঙ্গীভূত; সেই বন্ধুত্ব হইতে বিরহিত জীবনকেই সে কল্পনা করিতে পারে না।

এ পর্যন্ত কোনো মানুষকেই বিনয় গোরার মতো তাহার হৃদয়ের এত কাছে আসিতে দেয় নাই। আজ পর্যন্ত সে কেবল বই পড়িয়াছে এবং গোরার সঙ্গে তর্ক করিয়াছে, ঝগড়া করিয়াছে, আর গোরাকেই ভালোবাসিয়াছে; সংসারে আর কাহাকেও কিছুমাত্র আমল দিবার অবকাশই হয় নাই। গোরারও ভক্তসম্প্রদায়ের অভাব নাই, কিন্তু বন্ধু বিনয় ছাড়া আর কেহই ছিল না। গোরার প্রকৃতির মধ্যে একটা নিঃসঙ্গতার ভাব আছে— এ দিকে সে সামান্য লোকের সঙ্গে মিশিতে অবজ্ঞা করে না— অথচ নানাবিধ লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করা তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অধিকাংশ লোকই তাহার সঙ্গে একটা দূরত্ব অনুভব না করিয়া থাকিতে পারে না।

আজ বিনয় বুঝিতে পারিল পরেশবাবুর পরিজনদের প্রতি তাহার হৃদয় গভীরতর রূপে আকৃষ্ট হইতেছে। অথচ আলাপ বেশিদিনের নহে। ইহাতে সে গোরার কাছে যেন একটা অপরাধের লজ্জা বোধ করিতে লাগিল।

এই যে বরদাসুন্দরী আজ বিনয়কে তাঁহার মেয়েদের ইংরেজি হস্তলিপি ও শিল্পকাজ দেখাইয়া ও আবৃত্তি শুনাইয়া মাতৃগর্ব প্রকাশ করিতেছিলেন, গোরার কাছে যে ইহা কিরূপ অবজ্ঞাজনক তাহা বিনয় মনে মনে সুস্পষ্ট কল্পনা করিতেছিল। বস্তুতই ইহার মধ্যে যথেষ্ট হাস্যকর ব্যাপার ছিল; এবং বরদাসুন্দরীর মেয়েরা যে অল্পস্বল্প ইংরেজি শিখিয়াছে, ইংরেজ মেমের কাছে প্রশংসা পাইয়াছে, এবং লেফ্‌‍টেনান্ট গবর্নরের স্ত্রীর কাছে ক্ষণকালের জন্য প্রশ্রয় লাভ করিয়াছে, এই গর্বের মধ্যে এক হিসাবে একটা দীনতাও ছিল। কিন্তু এ-সমস্ত বুঝিয়া জানিয়াও বিনয় এ ব্যাপারটাকে গোরার আদর্শ-অনুসারে ঘৃণা করিতে পারে নাই। তাহার এ-সমস্ত বেশ ভালোই লাগিতেছিল। লাবণ্যের মতো মেয়ে— মেয়েটি দিব্য সুন্দর দেখিতে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই— বিনয়কে নিজের হাতের লেখা মূরের কবিতা দেখাইয়া যে বেশ একটু অহংকার বোধ করিতেছিল, ইহাতে বিনয়েরও অহংকারের তৃপ্তি হইয়াছিল। বরদাসুন্দরীর মধ্যে এ কালের ঠিক রঙটি ধরে নাই অথচ তিনি অতিরিক্ত উদগ্রভাবে একালীয়তা ফলাইতে ব্যস্ত— বিনয়ের কাছে এই অসামঞ্জস্যের অসংগতিটা ধরা পড়ে নাই যে তাহা নহে, তবুও বরদাসুন্দরীকে বিনয়ের বেশ ভালো লাগিয়াছিল; তাঁহার অহংকার ও অসহিষ্ণুতার সারল্যটুকুতে বিনয়ের প্রীতি বোধ হইয়াছিল। মেয়েরা যে তাহাদের হাসির শব্দে ঘর মধুর করিয়া রাখিয়াছে, চা তৈরি করিয়া পরিবেশন করিতেছে, নিজেদের হাতের শিল্পে ঘরের দেয়াল সাজাইয়াছে, এবং সেইসঙ্গে ইংরেজি কবিতা পড়িয়া উপভোগ করিতেছে, ইহা যতই সামান্য হউক বিনয় ইহাতেই মুগ্ধ হইয়াছে। বিনয় এমন রস তাহার মানবসঙ্গবিরল জীবনে আর কখনো পায় নাই। এই মেয়েদের বেশভূষা হাসিকথা কাজকর্ম লইয়া কত মধুর ছবিই যে সে মনে মনে আঁকিতে লাগিল তাহার আর সংখ্যা নাই। শুধু বই