গোরা
কেবলমাত্র নিজের মত প্রকাশ করিবারই আনন্দ? সেই আনন্দদানে সুচরিতারও কি কোনো হাত ছিল না? হয়তো ছিল না। হয়তো গোরার কাছে কোনো মানুষের কোনো মূল্য নাই, সে নিজের মত এবং উদ্দেশ্য লইয়াই একেবারে সকলের নিকট হইতে সুদূর হইয়া আছে— মানুষরা তাহার কাছে মত প্রয়োগ করিবার উপলক্ষমাত্র।

সুচরিতা এ কয়দিন বিশেষ করিয়া উপাসনায় মন দিয়াছিল। সে যেন পূর্বের চেয়েও পরেশবাবুকে বেশি করিয়া আশ্রয় করিবার চেষ্টা করিতেছিল। একদিন পরেশবাবু তাঁহার ঘরে একলা বসিয়া পড়িতেছিলেন, এমন সময় সুচরিতা তাঁহার কাছে চুপ করিয়া আসিয়া বসিল।

পরেশবাবু বই টেবিলের উপর রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রাধে?”

সুচরিতা কহিল, “কিছু না।”

বলিয়া তাঁহার টেবিলের উপরে যদিচ বই-কাগজ প্রভৃতি গোছানোই ছিল তবু সেগুলিকে নাড়িয়া-চাড়িয়া অন্যরকম করিয়া গুছাইতে লাগিল।

একটু পরে বলিয়া উঠিল, “বাবা, আগে তুমি আমাকে যেরকম পড়াতে এখন সেইরকম করে পড়াও না কেন?”

পরেশবাবু সস্নেহে একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, “আমার ছাত্রী যে আমার ইস্কুল থেকে পাস করে বেরিয়ে গেছে। এখন তো তুমি নিজে পড়েই বুঝতে পার।”

সুচরিতা কহিল, “না, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারি নে, আমি আগের মতো তোমার কাছে পড়ব।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, কাল থেকে পড়াব।”

সুচরিতা আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “বাবা, সেদিন বিনয়বাবু জাতিভেদের কথা অনেক বললেন, তুমি আমাকে সে সম্বন্ধে কিছু বুঝিয়ে বল না কেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “মা, তুমি তো জানই, তোমরা আপনি ভেবে বুঝতে চেষ্টা করবে, আমার বা আর-কারও মত কেবল অভ্যস্ত কথার মতো ব্যবহার করবে না, আমি বরাবর তোমাদের সঙ্গে সেইরকম করেই ব্যবহার করেছি। প্রশ্নটা ঠিকমত মনে জেগে ওঠবার পূর্বেই সে সম্বন্ধে কোনো উপদেশ দিতে যাওয়া আর ক্ষুধা পাবার পূর্বেই খাবার খেতে দেওয়া একই, তাতে কেবল অরুচি এবং অপাক হয়। তুমি আমাকে যখনই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে আমি যা বুঝি বলব।”

সুচরিতা কহিল, “আমি তোমাকে প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করছি, আমরা জাতিভেদকে নিন্দা করি কেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “একটা বিড়াল পাতের কাছে বসে ভাত খেলে কোনো দোষ হয় না অথচ একজন মানুষ সে ঘরে প্রবেশ করলে ভাত ফেলে দিতে হয়, মানুষের প্রতি মানুষের এমন অপমান এবং ঘৃণা যে জাতিভেদে জন্মায় সেটাকে অধর্ম না বলে কী বলব? মানুষকে যারা এমন ভয়ানক অবজ্ঞা করতে পারে তারা কখনোই পৃথিবীতে বড়ো হতে পারে না, অন্যের অবজ্ঞা তাদের সইতেই হবে।”

সুচরিতা গোরার মুখে শোনা কথার অনুসরণ করিয়া কহিল, “এখনকার সমাজে যে বিকার উপস্থিত হয়েছে তাতে অনেক দোষ থাকতে পারে; সে দোষ তো সমাজের সকল জিনিসেই ঢুকেছে, তাই বলে আসল জিনিসটাকে দোষ দেওয়া যায় কি?”

পরেশবাবু তাঁহার স্বাভাবিক শান্তস্বরে কহিলেন, “আসল জিনিসটা কোথায় আছে জানলে বলতে পারতুম। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে মানুষ মানুষকে অসহ্য ঘৃণা করছে এবং তাতে আমাদের সকলকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, এমন অবস্থায় একটা কাল্পনিক আসল জিনিসের কথা চিন্তা করে মন সান্ত্বনা মানে কই?”

সুচরিতা পুনশ্চ গোরাদের কথার প্রতিধ্বনি-স্বরূপে কহিল, “আচ্ছা, সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখাই তো আমাদের দেশের চরমতত্ত্ব