প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পরেশবাবু কহিলেন, “সমদৃষ্টিতে দেখা জ্ঞানের কথা, হৃদয়ের কথা নয়। সমদৃষ্টির মধ্যে প্রেমও নেই, ঘৃণাও নেই— সমদৃষ্টি রাগদ্বেষের অতীত। মানুষের হৃদয় এমনতরো হৃদয়ধর্মবিহীন জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেইজন্যে আমাদের দেশে এরকম সাম্যতত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও নীচ জাতকে দেবালয়ে পর্যন্ত প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। যদি দেবতার ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে সাম্য না থাকে তবে দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সে তত্ত্ব থাকলেই কী আর না থাকলেই কী?”
সুচরিতা পরেশবাবুর কথা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া মনে মনে বুঝিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। অবশেষে কহিল, “আচ্ছা বাবা, তুমি বিনয়বাবুদের এ-সব কথা বোঝাবার চেষ্টা কর না কেন?”
পরেশবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, “বিনয়বাবুদের বুদ্ধি কম বলে যে এ-সব কথা বোঝেন না তা নয়, বরঞ্চ তাঁদের বুদ্ধি বেশি বলেই তাঁরা বুঝতে চান না, কেবল বোঝাতেই চান। তাঁরা যখন ধর্মের দিক থেকে অর্থাৎ সকলের চেয়ে বড়ো সত্যের দিক থেকে এ-সব কথা অন্তরের সঙ্গে বুঝতে চাইবেন তখন তোমার বাবার বুদ্ধির জন্যে তাঁদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে না। এখন তাঁরা অন্য দিক থেকে দেখছেন, এখন আমার কথা তাঁদের কোনো কাজেই লাগবে না।”
গোরাদের কথা যদিও সুচরিতা শ্রদ্ধার সহিত শুনিতেছিল, তবু তাহা তাহার সংস্কারের সহিত বিবাদ বাধাইয়া তাহার অন্তরের মধ্যে বেদনা দিতেছিল। সে শান্তি পাইতেছিল না। আজ পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিয়া সেই বিরোধ হইতে সে ক্ষণকালের জন্য মুক্তিলাভ করিল। গোরা বিনয় বা আর-কেহই যে পরেশবাবুর চেয়ে কোনো বিষয়ে ভালো বুঝে, এ কথা সুচরিতা কোনোমতেই মনে স্থান দিতে চায় না। পরেশবাবুর সঙ্গে যাহার মতের অনৈক্য হইয়াছে সুচরিতা তাহার উপর রাগ না করিয়া থাকিতে পারে নাই। সম্প্রতি গোরার সঙ্গে আলাপের পর গোরার কথা একেবারে রাগ বা অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দিতে পারিতেছিল না বলিয়াই সুচরিতা এমন একটা কষ্ট বোধ করিতেছিল। সেই কারণেই আবার শিশুকালের মতো করিয়া পরেশবাবুকে তাঁহার ছায়াটির ন্যায় নিয়ত আশ্রয় করিবার জন্য তাহার হৃদয়ের মধ্যে ব্যাকুলতা উপস্থিত হইয়াছিল। চৌকি হইতে উঠিয়া দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া সুচরিতা পরেশবাবুর পিছনে তাঁহার চৌকির পিঠের উপর হাত রাখিয়া কহিল, “বাবা, আজ বিকালে আমাকে নিয়ে উপাসনা কোরো।”
পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা।”
তাহার পরে নিজের শোবার ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া সুচরিতা গোরার কথাকে একেবারে অগ্রাহ্য করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু গোরার সেই বুদ্ধি ও বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুখ তাহার চোখের সম্মুখে জাগিয়া রহিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, গোরার কথা শুধু কথা নহে, সে যেন গোরা স্বয়ং; সে কথার আকৃতি আছে, গতি আছে, প্রাণ আছে— তাহা বিশ্বাসের বলে এবং স্বদেশপ্রেমের বেদনায় পরিপূর্ণ। তাহা মত নয় যে তাহাকে প্রতিবাদ করিয়াই চুকাইয়া দেওয়া যাইবে— তাহা যে সম্পূর্ণ মানুষ— এবং সে মানুষ সামান্য মানুষ নহে। তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিতে যে হাত ওঠে না। অত্যন্ত একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়িয়া সুচরিতার কান্না আসিতে লাগিল। কেহ যে তাহাকে এত বড়ো একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলিয়া দিয়া সম্পূর্ণ উদাসীনের মতো অনায়াসে দূরে চলিয়া যাইতে পারে এই কথা মনে করিয়া তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে চাহিল, অথচ কষ্ট পাইতেছে বলিয়াও ধিক্কারের সীমা রহিল না।