প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বিনয়কে বাড়িতে পাইয়াও দুই-এক দিন মহিম তাহাকে বিবাহের কথা বলিতে পারেন নাই। গোরার কারাবাস-সম্বন্ধে তাহার মন বিষণ্ন ছিল বলিয়া তিনি নিরস্ত ছিলেন।
আজ রবিবার ছিল। গৃহিণী মহিমের সাপ্তাহিক দিবানিদ্রাটি সম্পূর্ণ হইতে দিলেন না। বিনয় নূতন-প্রকাশিত বঙ্কিমের ‘বঙ্গদর্শন’ লইয়া আনন্দময়ীকে শুনাইতেছিল— পানের ডিবা হাতে লইয়া সেইখানে আসিয়া মহিম তক্তপোশের উপরে ধীরে ধীরে বসিলেন।
প্রথমত বিনয়কে একটা পান দিয়া তিনি গোরার উচ্ছৃঙ্খল নির্বুদ্ধিতা লইয়া বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। তাহার পরে তাহার খালাস হইতে আর কয়দিন বাকি তাহা আলোচনা করিতে গিয়া অত্যন্ত অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গেল যে, অঘ্রান মাসের প্রায় অর্ধেক হইয়া আসিয়াছে।
কহিলেন, “বিনয়, তুমি যে বলেছিলে অঘ্রান মাসে তোমাদের বংশে বিবাহ নিষেধ আছে, সেটা কোনো কাজের কথা নয়। একে তো পাঁজিপুঁথিতে নিষেধ ছাড়া কথাই নেই, তার উপরে যদি ঘরের শাস্ত্র বানাতে থাক তা হলে বংশরক্ষা হবে কী করে?”
বিনয়ের সংকট দেখিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “শশিমুখীকে এতটুকুবেলা থেকে বিনয় দেখে আসছে— ওকে বিয়ে করার কথা ওর মনে লাগছে না; সেইজন্যেই অঘ্রান মাসের ছুতো করে বসে আছে।”
মহিম কহিলেন, “সে কথা তো গোড়ায় বললেই হত।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের মন বুঝতেও যে সময় লাগে। পাত্রের অভাব কী আছে মহিম। গোরা ফিরে আসুক— সে তো অনেক ভালো ছেলেকে জানে— সে একটা ঠিক করে দিতে পারবে।”
মহিম মুখ অন্ধকার করিয়া কহিলেন, “হুঁ।” খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পরে কহিলেন, “মা, তুমি যদি বিনয়ের মন ভাঙিয়ে না দিতে তা হলে ও এ কাজে আপত্তি করত না।”
বিনয় ব্যস্ত হইয়া কী একটা বলিতে যাইতেছিল, আনন্দময়ী বাধা দিয়া কহিলেন, “তা, সত্য কথা বলছি মহিম, আমি ওকে উৎসাহ দিতে পারি নি। বিনয় ছেলেমানুষ, ও হয়তো না বুঝে একটা কাজ করে বসতেও পারত, কিন্তু শেষকালে ভালো হত না।”
আনন্দময়ী বিনয়কে আড়ালে রাখিয়া নিজের ’পরেই মহিমের রাগের ধাক্কাটা গ্রহণ করিলেন। বিনয় তাহা বুঝিতে পারিয়া নিজের দুর্বলতায় লজ্জিত হইয়া উঠিল। সে নিজের অসম্মতি স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিতে উদ্যত হইলে মহিম আর অপেক্ষা না করিয়া মনে মনে এই বলিতে বলিতে বাহির হইয়া গেলেন যে, বিমাতা কখনো আপন হয় না।
মহিম যে এ কথা মনে করিতে পারেন এবং বিমাতা বলিয়া তিনি যে সংসারের বিচারক্ষেত্রে বরাবর আসামী-শ্রেণীতেই ভুক্ত আছেন আনন্দময়ী তাহা জানিতেন। কিন্তু লোকে কী মনে করিবে এ কথা ভাবিয়া চলা তাঁহার অভ্যাসই ছিল না। যেদিন তিনি গোরাকে কোলে তুলিয়া লইয়াছেন সেইদিন হইতেই লোকের আচার, লোকের বিচার হইতে তাঁহার প্রকৃতি একেবারে স্বতন্ত্র হইয়া গেছে। সেদিন হইতে তিনি এমন-সকল আচরণ করিয়া আসিয়াছেন যাহাতে লোকে তাঁহার নিন্দাই করে। তাঁহার জীবনের মর্মস্থানে যে একটি সত্যগোপন তাঁহাকে সর্বদা পীড়া দিতেছে লোকনিন্দায় তাঁহাকে সেই পীড়া হইতে কতকটা পরিমাণে মুক্তি দান করে। লোকে যখন তাঁহাকে খৃস্টান বলিত তিনি গোরাকে কোলে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন— ‘ভগবান জানেন খৃস্টান বলিলে আমার নিন্দা