গোরা
হয় না।’ এমনি করিয়া ক্রমে সকল বিষয়েই লোকের কথা হইতে নিজের ব্যবহারকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়া তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ হইয়াছিল। এইজন্য মহিম তাঁহাকে মনে মনে বা প্রকাশ্যে বিমাতা বলিয়া লাঞ্ছিত করিলেও তিনি নিজের পথ হইতে বিচলিত হইতেন না।

আনন্দময়ী কহিলেন, “বিনু, তুমি পরেশবাবুদের বাড়ি অনেক দিন যাও নি।”

বিনয় কহিল, “অনেক দিন আর কই হল?”

আনন্দময়ী। স্টীমার থেকে আসার পরদিন থেকে তো একবারও যাও নি।

সে তো বেশিদিন নহে। কিন্তু বিনয় জানিত, মাঝে পরেশবাবুর বাড়ি তাহার যাতায়াত এত বাড়িয়াছিল যে আনন্দময়ীর পক্ষেও তাহার দর্শন দুর্লভ হইয়া উঠিয়াছিল। সে হিসাবে পরেশবাবুর বাড়ি অনেক দিন যাওয়া হয় নাই এবং লোকের তাহা লক্ষ্য করিবার বিষয় হইয়াছে বটে।

বিনয় নিজের ধুতির প্রান্ত হইতে একটা সুতা ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে চুপ করিয়া রহিল।

এমন সময় বেহারা আসিয়া খবর দিল, “মাজি, কাঁহাসে মায়ীলোক আয়া।”

বিনয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। কে আসিল, কোথা হইতে আসিল, খবর লইতে লইতেই সুচরিতা ও ললিতা ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। বিনয়ের ঘর ছাড়িয়া বাহিরে যাওয়া ঘটিল না; সে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

দুজনে আনন্দময়ীর পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। ললিতা বিনয়কে বিশেষ লক্ষ্য করিল না; সুচরিতা তাহাকে নমস্কার করিয়া কহিল, “ভালো আছেন?”

আনন্দময়ীর দিকে চাহিয়া সে কহিল, “আমরা পরেশবাবুর বাড়ি থেকে আসছি।”

আনন্দময়ী তাহাদিগকে আদর করিয়া বসাইয়া কহিলেন, “আমাকে সে পরিচয় দিতে হবে না। তোমাদের দেখি নি, মা, কিন্তু তোমাদের আপনার ঘরের বলেই জানি।”

দেখিতে দেখিতে কথা জমিয়া উঠিল। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া আছে দেখিয়া সুচরিতা তাহাকে আলাপের মধ্যে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল; মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি অনেক দিন আমাদের ওখানে যান নি যে?”

বিনয় ললিতার দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া লইয়া কহিল, “ঘন ঘন বিরক্ত করলে পাছে আপনাদের স্নেহ হারাই, মনে এই ভয় হয়।”

সুচরিতা একটু হাসিয়া কহিল, “স্নেহও যে ঘন ঘন বিরক্তির অপেক্ষা রাখে, সে আপনি জানেন না বুঝি?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ও খুব জানে মা! কী বলব তোমাদের— সমস্ত দিন ওর ফরমাশে আর আবদারে আমার যদি একটু অবসর থাকে।”

এই বলিয়া স্নিগ্ধদৃষ্টি-দ্বারা বিনয়কে নিরীক্ষণ করিলেন।

বিনয় কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ধৈর্য দিয়েছেন, আমাকে দিয়ে তারই পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন।”

সুচরিতা ললিতাকে একটু ঠেলা দিয়া কহিল, “শুনছিস ভাই ললিতা, আমাদের পরীক্ষাটা বুঝি শেষ হয়ে গেল! পাস করতে পারি নি বুঝি?”

ললিতা এ কথায় কিছুমাত্র যোগ দিল না দেখিয়া আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “এবার আমাদের বিনু নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন। তোমাদের ও যে কী চক্ষে দেখেছে সে তো তোমরা জান না। সন্ধেবেলায় তোমাদের কথা ছাড়া কথা নেই। আর পরেশবাবুর কথা উঠলে ও তো একেবারে গলে যায়।”