প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বিনয় ঘরে ঢুকিলে সুচরিতা এবং ললিতা তাহাকে দেখিয়া আশ্চর্য হইল। সে যে কত অকস্মাৎ কী কঠিন আঘাত পাইয়াছে তাহা এই অল্প সময়ের মধ্যে তাহার মুখে চিহ্নিত হইয়া গিয়াছে। সে সরস শ্যামল ক্ষেত্রের উপর দিয়া হঠাৎ কোথা হইতে পঙ্গপাল পড়িয়া চলিয়া গিয়াছে বিনয়ের নিত্যসহাস্য মুখের সেই ক্ষেত্রের মতো চেহারা হইয়াছে। ললিতার মনে বেদনা এবং করুণার সঙ্গে একটু আনন্দের আভাসও দেখা দিল।
অন্য দিন হইলে ললিতা সহসা বিনয়ের সঙ্গে কথা আরম্ভ করিত না— আজ যেমনি বিনয় ঘরে প্রবেশ করিল অমনি সে বলিয়া উঠিল, “বিনয়বাবু, আপনার সঙ্গে আমাদের একটা পরামর্শ আছে।”
বিনয়ের বুকে কে যেন হঠাৎ একটা শব্দভেদী আনন্দের বাণ ছুঁড়িয়া মারিল। সে উল্লাসে চকিত হইয়া উঠিল। তাহার বিবর্ণ মলান মুখে মুহূর্তেই দীপ্তির সঞ্চার হইল।
ললিতা কহিল, “আমরা কয় বোনে মিলে একটি ছোটোখাটো মেয়ে-ইস্কুল করতে চাই।”
বিনয় উৎসাহিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “মেয়ে-ইস্কুল করা অনেক দিন থেকে আমার জীবনের একটা সংকল্প।”
ললিতা কহিল, “আপনাকে এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করতে হবে।”
বিনয় কহিল, “আমার দ্বারা যা হতে পারে তার কোনো ত্রুটি হবে না। আমাকে কী করতে হবে বলুন।”
ললিতা কহিল, “আমরা ব্রাহ্ম বলে হিন্দু অভিভাবকেরা আমাদের বিশ্বাস করে না। এ বিষয়ে আপনাকে চেষ্টা দেখতে হবে।”
বিনয় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আপনি কিচ্ছু ভয় করবেন না— আমি পারব।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ও খুব পারবে। লোককে কথায় ভুলিয়ে বশ করতে ওর জুড়ি কেউ নেই।”
ললিতা কহিল, “বিদ্যালয়ের কাজকর্ম যে নিয়মে যেরকম করে চালানো উচিত— সময় ভাগ করা, ক্লাস ভাগ করা, বই ঠিক করে দেওয়া, এ-সমস্তই আপনাকে করে দিতে হবে।”
এ কাজটাও বিনয়ের পক্ষে শক্ত নহে, কিন্তু তাহার ধাঁধা লাগিয়া গেল। বরদাসুন্দরী তাঁহার মেয়েদের সহিত তাহাকে মিশিতে নিষেধ করিয়া দিয়াছেন এবং সমাজে তাহাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলিতেছে, এ কথাটা কি ললিতা একেবারেই জানে না? এ স্থলে বিনয় যদি ললিতার অনুরোধ রাখিতে প্রতিশ্রুত হয় তবে সেটা অন্যায় এবং ললিতার পক্ষে অনিষ্টকর হইবে কি না এই প্রশ্ন তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। এ দিকে ললিতা যদি কোনো শুভকর্মে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করে তবে সমস্ত চেষ্টা দিয়া সেই অনুরোধ পালন না করিবে এমন শক্তি বিনয়ের কোথায়?
এ পক্ষে সুচরিতাও আশ্চর্য হইয়া গেছে। সে স্বপ্নেও মনে করে নাই ললিতা হঠাৎ এমন করিয়া বিনয়কে মেয়ে-ইস্কুলের জন্য অনুরোধ করিবে। একে তো বিনয়কে লইয়া যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি হইয়াছে তাহার পরে এ আবার কী কাণ্ড! ললিতা জানিয়া-শুনিয়া ইচ্ছাপূর্বক এই ব্যাপারটি ঘটাইয়া তুলিতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া সুচরিতা ভীত হইয়া উঠিল। ললিতার মনে বিদ্রোহ জাগিয়া উঠিয়াছে তাহা সে বুঝিল, কিন্তু বেচারা বিনয়কে এই উৎপাতের মধ্যে জড়িত করা কি তাহার উচিত হইতেছে? সুচরিতা উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “এ সম্বন্ধে একবার বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে তো। মেয়ে-ইস্কুলে ইন্সপেক্টারি পদ পেলেন বলে বিনয়বাবু এখনই যেন খুব বেশি আশান্বিত হয়ে না ওঠেন।”
সুচরিতা কৌশলে প্রস্তাবটাকে যে বাধা দিল তাহা বিনয় বুঝিতে পারিল, ইহাতে তাহার মনে আরো খটকা বাজিল। বেশ বোঝা যাইতেছে, যে সংকট উপস্থিত হইয়াছে তাহা সুচরিতা জানে, সুতরাং নিশ্চয়ই তাহা ললিতার অগোচর নহে, তবে ললিতা কেন—