গোরা
থাকবে কেন?”

সুচরিতা কহিল, “নইলে মা ভারি বিরক্ত হয়ে উঠবেন।”

পরেশ ভাবিয়া দেখিলেন সে কথা ঠিক।

সতীশ ঘরে ঢুকিয়া সুচরিতার কানে কানে কী কহিল। সুচরিতা কহিল, “না ভাই বক্তিয়ার, এখন না। কাল হবে।”

সতীশ বিমর্ষ হইয়া কহিল, “কাল যে আমার ইস্কুল আছে।”

পরেশ স্নেহহাস্য হাসিয়া কহিলেন, “কী সতীশ, কী চাই?”

সুচরিতা কহিল, “ওর একটা—”

সতীশ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া সুচরিতার মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, “না না, বোলো না, বোলো না।”

পরেশবাবু কহিলেন, “যদি গোপন কথা হয় তা হলে সুচরিতা বলবে কেন?”

সুচরিতা কহিল, “না বাবা, নিশ্চয় ওর ভারি ইচ্ছে যাতে এই গোপন কথাটা তোমার কানে ওঠে।”

সতীশ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “কক্‌খনো না, নিশ্চয় না।”

বলিয়া সে দৌড় দিল।

বিনয় তাহার যে রচনার এত প্রশংসা করিয়াছিল সেই রচনাটা সুচরিতাকে দেখাইবার কথা ছিল। বলা বাহুল্য পরেশের সামনে সেই কথাটা সুচিরতার কানে কানে স্মরণ করাইয়া দিবার উদ্দেশ্যটা যে কী তাহা সুচরিতা ঠিক ঠাওরাইয়াছিল। এমন-সকল গভীর মনের অভিপ্রায় সংসারে যে এত সহজে ধরা পড়িয়া যায়, বেচারা সতীশের তাহা জানা ছিল না।

৪৭

চারি দিন পরে একখানি চিঠি হাতে করিয়া হারানবাবু বরদাসুন্দরীর কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আজকাল পরেশবাবুর আশা তিনি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছেন।

হারানবাবু চিঠিখানি বরদাসুন্দরীর হাতে দিয়া কহিলেন, “আমি প্রথম হতেই আপনাদের সাবধান করে দিতে অনেক চেষ্টা করেছি। সেজন্যে আপনাদের অপ্রিয়ও হয়েছি। এখন এই চিঠি থেকেই বুঝতে পারবেন ভিতরে ভিতরে ব্যাপারটা কতদূর এগিয়ে পড়েছে।”

শৈলবালাকে ললিতা যে চিঠি লিখিয়াছিল সেই চিঠিখানি বরদাসুন্দরী পাঠ করিলেন। কহিলেন, “কেমন করে জানব বলুন। কখনো যা মনেও করতে পারি নি তাই ঘটছে। এর জন্যে কিন্তু আমাকে দোষ দেবেন না তা আমি বলে রাখছি। সুচরিতাকে যে আপনারা সকলে মিলে বড্ডো ভালো ভালো করে একেবারে তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন— ব্রাহ্মসমাজে অমন মেয়ে আর হয় না— এখন আপনাদের ঐ আদর্শ ব্রাহ্ম মেয়েটির কীর্তি সামলান। বিনয়-গৌরকে তো উনিই এ বাড়িতে এনেছেন। আমি তবু বিনয়কে অনেকটা আমাদের পথেই টেনে আনছিলুম, তার পরে কোথা থেকে উনি ওঁর এক মাসিকে এনে আমাদেরই ঘরে ঠাকুর-পুজো শুরু করে দিলেন। বিনয়কেও এমনি বিগড়ে দিলেন যে, সে এখন আমাকে দেখলেই পালায়। এখন এ-সব যা-কিছু ঘটছে আপনাদের ঐ সুচরিতাই এর গোড়ায়। ও মেয়ে যে কেমন মেয়ে সে আমি বরাবরই জানতুম— কিন্তু কখনো কোনো কথাটি কই নি, বরাবর ওকে এমন করেই মানুষ করে এসেছি যে কেউ টের পায় নি ও আমার আপন মেয়ে নয়— আজ তার বেশ ফল পাওয়া গেল। এখন আপনাকে এ চিঠি মিথ্যা দেখাচ্ছেন— আপনারা যা হয় করুন।”