প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া নিভৃত ঘরে বসিলেন এবং কহিলেন, “মা, ললিতা সম্বন্ধে ভাবনার সময় উপস্থিত হয়েছে।”
সুচরিতা পরেশবাবুর মুখে তাহার করুণাপূর্ণ দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, “জানি বাবা!”
পরেশবাবু কহিলেন, “আমি সামাজিক নিন্দার কথা ভাবছি নে। আমি ভাবছি— আচ্ছা ললিতা কি—”
পরেশের সংকোচ দেখিয়া সুচরিতা আপনিই কথাটাকে স্পষ্ট করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। সে কহিল, “ললিতা বরাবর তার মনের কথা আমার কাছে খুলে বলে। কিন্তু কিছুদিন থেকে সে আমার কাছে আর তেমন করে ধরা দেয় না। আমি বেশ বুঝতে পারছি—”
পরেশ মাঝখান হইতে কহিলেন, “ললিতার মনে এমন কোনো ভাবের উদয় হয়েছে যেটা সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাচ্ছে না। আমি ভেবে পাচ্ছি নে কী করলে ওর ঠিক— তুমি কি বল বিনয়কে আমাদের পরিবারে যাতায়াত করতে দিয়ে ললিতার কোনো অনিষ্ট করা হয়েছে?”
সুচরিতা কহিল, “বাবা, তুমি তো জান বিনয়বাবুর মধ্যে কোনো দোষ নেই— তাঁর নির্মল স্বভাব— তাঁর মতো স্বভাবতই ভদ্রলোক খুব অল্পই দেখা যায়।”
পরেশবাবু যেন একটা কোন্ নূতন তত্ত্ব লাভ করিলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা বলেছ, রাধে, ঠিক কথা বলেছ। তিনি ভালো লোক কিনা এইটেই দেখবার বিষয়— অন্তর্যামী ঈশ্বরও তাই দেখেন। বিনয় যে ভালো লোক, সেখানে যে আমার ভুল হয় নি, সেজন্যে আমি তাঁকে বার বার প্রণাম করি।”
একটা জাল কাটিয়া গেল— পরেশবাবু যেন বাঁচিয়া গেলেন। পরেশবাবু তাঁহার দেবতার কাছে অন্যায় করেন নাই। ঈশ্বর যে তুলাদণ্ডে মানুষকে ওজন করেন সেই নিত্যধর্মের তুলাকেই তিনি মানিয়াছেন— তাহার মধ্যে তিনি নিজের সমাজের তৈরি কোনো কৃত্রিম বাটখারা মিশান নাই বলিয়া তাঁহার মনে আর কোনো গ্লানি রহিল না। এই অত্যন্ত সহজ কথাটা এতক্ষণ তিনি না বুঝিয়া কেন এমন পীড়া অনুভব করিতেছিলেন বলিয়া তাঁহার আশ্চর্য বোধ হইল। সুচরিতার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, “তোমার কাছে আমার আজ একটা শিক্ষা হল মা!”
সুচরিতা তৎক্ষণাৎ তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া কহিল, “না না, কী বল বাবা!”
পরেশবাবু কহিলেন, “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিয়ে দেয়— মানুষ ব্রাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্বসত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে— এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।”
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া পরেশ কহিলেন, “ললিতা তার মেয়ে-ইস্কুলের সংকল্প কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। সে এ সম্বন্ধে বিনয়ের সাহায্য নেবার জন্যে আমার সম্মতি চায়।”
সুচরিতা কহিল, “না বাবা, এখন কিছুদিন থাক্।”
ললিতাকে তিনি নিষেধ করিবামাত্র সে যে তাহার ক্ষুব্ধ হৃদয়ের সমস্ত বেগ দমন করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল সেই ছবিটি পরেশের স্নেহপূর্ণ হৃদয়কে অত্যন্ত ক্লেশ দিতেছিল। তিনি জানিতেন, তাঁহার তেজস্বিনী কন্যার প্রতি সমাজ যে অন্যায় উৎপীড়ন করিতেছে সেই অন্যায়ে সে তেমন কষ্ট পায় নাই যেমন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে বাধা পাইয়া, বিশেষত পিতার নিকট হইতে বাধা পাইয়া। এইজন্য তিনি তাঁহার নিষেধ উঠাইয়া লইবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিলেন। তিনি কহিলেন, “কেন রাধে, এখন