গোরা

পরেশ কহিলেন, “বিনয়! বিনয় রাজি হবেন কেন?”

ললিতার অভিমানে আঘাত লাগিল। বিনয়বাবু রাজি হবেন না! ললিতা এটুকু বেশ বুঝিয়াছে, বিনয়বাবুকে রাজি করানো ললিতার পক্ষে অসাধ্য নহে।

ললিতা কহিল, “তা তিনি রাজি হতে পারেন।”

পরেশ একটু স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া কহিলেন, “সব কথা বিবেচনা করে দেখলে কখনোই তিনি রাজি হবেন না।”

ললিতার কর্ণমূল লাল হইয়া উঠিল। সে নিজের আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা লইয়া নাড়িতে লাগিল।

তাঁহার এই নিপীড়িতা কন্যার মুখের দিকে তাকাইয়া পরেশের হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। কিন্তু কোনো সান্ত্বনার বাক্য খুঁজিয়া পাইলেন না। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে ললিতা মুখ তুলিয়া কহিল, “বাবা, তা হলে আমাদের এই ইস্কুলটা কোনোমতেই হতে পারবে না!”

পরেশ কহিলেন, “এখন হওয়ার অনেক বাধা দেখতে পাচ্ছি। চেষ্টা করতে গেলেই বিস্তর অপ্রিয় আলোচনাকে জাগিয়ে তোলা হবে।”

শেষকালে পানুবাবুরই জিত হইবে এবং অন্যায়ের কাছে নিঃশব্দে হার মানিতে হইবে, ললিতার পক্ষে এমন দুঃখ আর-কিছুই নাই। এ সম্বন্ধে তাহার বাপ ছাড়া আর-কাহারো শাসন সে এক মুহূর্ত বহন করিতে পারিত না। সে কোনো অপ্রিয়তাকে ডরায় না, কিন্তু অন্যায়কে কেমন করিয়া সহ্য করিবে! ধীরে ধীরে পরেশবাবুর কাছ হইতে সে উঠিয়া গেল।

নিজের ঘরে গিয়া দেখিল তাহার নামে ডাকে একখানা চিঠি আসিয়াছে। হাতের অক্ষর দেখিয়া বুঝিল তাহার বাল্যবন্ধু শৈলবালার লেখা। সে বিবাহিত, তাহার স্বামীর সঙ্গে বাঁকিপুরে থাকে।

চিঠির মধ্যে ছিল—

   ‘তোমাদের সম্বন্ধে নানা কথা শুনিয়া মন বড়ো খারাপ ছিল। অনেক দিন হইতে ভাবিতেছি চিঠি লিখিয়া

সংবাদ লইব— সময় হইয়া উঠে নাই। কিন্তু পরশু একজনের কাছ হইতে (তাহার নাম করিব না) যে খবর

পাইলাম শুনিয়া যেন মাথায় বজ্রাঘাত হইল। এ যে সম্ভব হইতে পারে তাহা মনেও করিতে পারি না। কিন্তু

যিনি লিখিয়াছেন তাঁহাকে অবিশ্বাস করাও শক্ত। কোনো হিন্দু যুবকের সঙ্গে নাকি তোমার বিবাহের সম্ভাবনা

ঘটিয়াছে। এ কথা যদি সত্য হয়’
                                                                                        ইত্যাদি ইত্যাদি।

ক্রোধে ললিতার সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিতে পারিল না। তখনই সে চিঠির উত্তরে লিখিল—

   ‘খবরটা সত্য কিনা ইহা জানিবার জন্য তুমি যে আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইয়াছ ইহাই আমার

কাছে আশ্চর্য বোধ হইতেছে। ব্রাহ্মসমাজের লোক তোমাকে যে খবর দিয়াছে তাহার সত্যও কি যাচাই

করিতে হইবে! এত অবিশ্বাস! তাহার পরে, কোনো হিন্দু যুবকের সঙ্গে আমার বিবাহের সম্ভাবনা ঘটিয়াছে

সংবাদ পাইয়া তোমার মাথায় বজ্রাঘাত হইয়াছে, কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয় বলিতে পারি ব্রাহ্মসমাজে এমন

সুবিখ্যাত সাধু যুবক আছেন যাঁহার সঙ্গে বিবাহের আশঙ্কা বজ্রাঘাতের তুল্য নিদারুণ এবং আমি এমন দুই-

একটি হিন্দু যুবককে জানি যাঁহাদের সঙ্গে বিবাহ যে কোনো ব্রাহ্মকুমারীর পক্ষে গৌরবের বিষয়। ইহার বেশি

আর একটি কথাও আমি তোমাকে বলিতে ইচ্ছা করি না।’

এ দিকে সেদিনকার মতো পরেশবাবুর কাজ বন্ধ হইয়া গেল। তিনি চুপ করিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। তাহার পরে