গোরা

অবিনাশের বাগ্মিতায় বিচলিত হইয়া সকলে মিলিয়া গৌরমোহনের জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। গোরা মর্মান্তিক পীড়া পাইয়া সেখান হইতে ছুটিয়া চলিয়া গেল।

আজ জেলখানা হইতে মুক্তির দিনে প্রবল একটা অবসাদ গোরার মনকে আক্রমণ করিল। নূতন উৎসাহে দেশের জন্য কাজ করিবে বলিয়া গোরা জেলের অবরোধে অনেক দিন কল্পনা করিয়াছে। আজ সে নিজেকে কেবল এই প্রশ্ন করিতে লাগিল— ‘হায়, আমার দেশ কোথায়! দেশ কি কেবল আমার একলার কাছে! আমার জীবনের সমস্ত সংকল্প যাহার সঙ্গে আলোচনা করিলাম সেই আমার আশৈশবের বন্ধু আজ এতদিন পরে কেবল একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করিবার উপলক্ষে তাহার দেশের সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে এক মুহূর্তে এমন নির্মমভাবে পৃথক হইতে প্রস্তুত হইল। আর যাহাদিগকে সকলে আমার দলের লোক বলে, এতদিন তাহাদিগকে এত বুঝানোর পরও তাহারা আজ এই স্থির করিল যে, আমি কেবল হিঁদুয়ানি উদ্ধার করিবার জন্যে অবতার হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি! আমি কেবল মূর্তিমান শাস্ত্রের বচন! আর, ভারতবর্ষ কোনোখানে স্থান পাইল না! ষড়্‌ঋতু! ভারতবর্ষে ষড়্‌ঋতু আছে! সেই ষড়্‌ঋতুর ষড়যন্ত্রে যদি অবিনাশের মতো এমন ফল ফলিয়া থাকে তবে দুই-চারিটা ঋতু কম থাকিলে ক্ষতি ছিল না।’

বেহারা আসিয়া খবর দিল, মা গোরাকে ডাকিতেছেন। গোরা যেন হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে আপনার মনে বলিয়া উঠিল, ‘মা ডাকিতেছেন!’ এই খবরটাকে সে যেন একটা নূতন অর্থ দিয়া শুনিল। সে কহিল, ‘আর যাই হউক, আমার মা আছেন। এবং তিনিই আমাকে ডাকিতেছেন। তিনিই আমাকে সকলের সঙ্গে মিলাইয়া দিবেন, কাহারো সঙ্গে তিনি কোনো বিচ্ছেদ রাখিবেন না। আমি দেখিব যাহারা আমার আপন তাহারা তাঁহার ঘরে বসিয়া আছে। জেলের মধ্যেও মা আমাকে ডাকিয়াছিলেন, সেখানে তাঁহার দেখা পাইয়াছি। জেলের বাহিরেও মা আমাকে ডাকিতেছেন, সেখানে আমি তাঁহাকে দেখিতে যাত্রা করিলাম।’ এই বলিয়া গোরা সেই শীতমধ্যাহ্নের আকাশের দিকে বাহিরে চাহিয়া দেখিল। এক দিকে বিনয় ও আর-এক দিকে অবিনাশের তরফ হইতে যে বিরোধের সুর উঠিয়াছিল তাহা যৎসামান্য হইয়া কাটিয়া গেল। এই মধ্যাহ্নসূর্যের আলোকে ভারতবর্ষ যেন তাহার বাহু উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিল। তাহার আসমুদ্রবিস্তৃত নদীপর্বত লোকালয় গোরার চক্ষের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল, অনন্তের দিক হইতে একটি মুক্ত নির্মল আলোক আসিয়া এই ভারতবর্ষকে সর্বত্র যেন জ্যোতির্ময় করিয়া দেখাইল। গোরার বক্ষ ভরিয়া উঠিল, তাহার দুই চক্ষু জ্বলিতে লাগিল, তাহার মনের কোথাও লেশমাত্র নৈরাশ্য রহিল না। ভারতবর্ষের যে কাজ অন্তহীন, যে কাজের ফল বহুদূরে তাহার জন্য তাহার প্রকৃতি আনন্দের সহিত প্রস্তুত হইল— ভারতবর্ষের যে মহিমা সে ধ্যানে দেখিয়াছে তাহাকে নিজের চক্ষে দেখিয়া যাইতে পারিবে না বলিয়া তাহার কিছুমাত্র ক্ষোভ রহিল না। সে মনে মনে বার বার করিয়া বলিল, ‘মা আমাকে ডাকিতেছেন— চলিলাম যেখানে অন্নপূর্ণা, যেখানে জগদ্ধাত্রী বসিয়া আছেন সেই সুদূরকালেই অথচ এই নিমেষেই, সেই মৃত্যুর পরপ্রান্তেই অথচ এই জীবনের মধ্যেই, সেই-যে মহামহিমান্বিত ভবিষ্যৎ আজ আমার এই দীনহীন বর্তমানকে সম্পূর্ণ সার্থক করিয়া উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছে— আমি চলিলাম সেইখানেই— সেই অতিদূরে সেই অতিনিকটে মা আমাকে ডাকিতেছেন।’ এই আনন্দের মধ্যে গোরা যেন বিনয় এবং অবিনাশের সঙ্গ পাইল, তাহারাও তাহার পর হইয়া রহিল না— অদ্যকার সমস্ত ছোটো বিরোধগুলি একটা প্রকাণ্ড চরিতার্থতায় কোথায় মিলাইয়া গেল।

গোরা যখন আনন্দময়ীর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল তখন তাহার মুখ আনন্দের আভায় দীপ্যমান, তখন তাহার চক্ষু যেন সম্মুখস্থিত সমস্ত পদার্থের পশ্চাতে আর-একটি কোন্‌ অপরূপ মূর্তি দেখিতেছে। প্রথমেই হঠাৎ আসিয়া সে যেন ভালো করিয়া চিনিতে পারিল না, ঘরে তাহার মা’র কাছে কে বসিয়া আছে।

সুচরিতা উঠিয়া দাঁড়াইয়া গোরাকে নমস্কার করিল। গোরা কহিল, “এই-যে, আপনি এসেছেন— বসুন।”