গোরা

গোরা এমন করিয়া বলিল ‘আপনি এসেছেন’, যেন সুচরিতার আসা একটা সাধারণ ঘটনার মধ্যে নয়, এ যেন একটা বিশেষ আবির্ভাব।

একদিন সুচরিতার সংস্রব হইতে গোরা পলায়ন করিয়াছিল। যত দিন পর্যন্ত সে নানা কষ্ট এবং কাজ লইয়া ভ্রমণ করিতেছিল ততদিন সুচরিতার কথা মন থেকে অনেকটা দূরে রাখিতে পারিয়াছিল। কিন্তু জেলের অবরোধের মধ্যে সুচরিতার স্মৃতিকে সে কোনোমতেই ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই। এমন একদিন ছিল যখন ভারতবর্ষে যে স্ত্রীলোক আছে সে কথা গোরার মনে উদয়ই হয় নাই। এই সত্যটি এতকাল পরে সে সুচরিতার মধ্যে নূতন আবিষ্কার করিল। একেবারে এক মুহূর্তে এতবড়ো একটা পুরাতন এবং প্রকাণ্ড কথাটাকে হঠাৎ গ্রহণ করিয়া তাহার সমগ্র বলিষ্ঠ প্রকৃতি ইহার আঘাতে কম্পিত হইয়া উঠিল। জেলের মধ্যে বাহিরের সূর্যালোক এবং মুক্ত বাতাসের জগৎ যখন তাহার মনের মধ্যে বেদনা সঞ্চার করিত তখন সেই জগৎটিকে কেবল সে নিজের কর্মক্ষেত্র এবং কেবল সেটাকে পুরুষসমাজ বলিয়া দেখিত না; যেমন করিয়াই সে ধ্যান করিত বাহিরের এই সুন্দর জগৎসংসারে সে কেবল দুটি অধিষ্ঠাত্রী দেবতার মুখ দেখিতে পাইত, সূর্য চন্দ্র তারার আলোক বিশেষ করিয়া তাহাদেরই মুখের উপর পড়িত, স্নিগ্ধ নীলিমামণ্ডিত আকাশ তাহাদেরই মুখকে বেষ্টন করিয়া থাকিত— একটি মুখ তাহার আজন্মপরিচিত মাতার, বুদ্ধিতে উদ্‌ভাসিত আর-একটি নম্র সুন্দর মুখের সঙ্গে তাহার নূতন পরিচয়।

জেলের নিরানন্দ সংকীর্ণতার মধ্যে গোরা এই মুখের স্মৃতির সঙ্গে বিরোধ করিতে পারে নাই। এই ধ্যানের পুলকটুকু তাহার জেলখানার মধ্যে একটি গভীরতর মুক্তিকে আনিয়া দিত। জেলখানার কঠিন বন্ধন তাহার কাছে যেন ছায়াময় মিথ্যা স্বপ্নের মতো হইয়া যাইত। স্পন্দিত হৃদয়ের অতীন্দ্রিয় তরঙ্গগুলি জেলের সমস্ত প্রাচীর অবাধে ভেদ করিয়া আকাশে মিশিয়া সেখানকার পুষ্পপল্লবে হিল্লোলিত এবং সংসারকর্মক্ষেত্রে লীলায়িত হইতে থাকিত।

গোরা মনে করিয়াছিল, কল্পনামূর্তিকে ভয় করিবার কোনো কারণ নাই। এইজন্য এক মাস কাল ইহাকে একেবারেই সে পথ ছড়িয়া দিয়াছিল। গোরা জানিত, ভয় করিবার বিষয় কেবলমাত্র বাস্তব পদার্থ।

জেল হইতে বাহির হইবামাত্র গোরা যখন পরেশবাবুকে দেখিল তখন তাহার মন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল। সে যে কেবল পরেশবাবুকে দেখার আনন্দ তাহা নহে; তাহার সঙ্গে গোরার এই কয়দিনের সঙ্গিনী কল্পনাও যে কতটা নিজের মায়া মিশ্রিত করিয়াছিল তাহা প্রথমটা গোরা বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু ক্রমেই বুঝিল। ষ্টীমারে আসিতে আসিতে সে স্পষ্টই অনুভব করিল, পরেশবাবু যে তাহাকে আকর্ষণ করিতেছেন সে কেবল তাঁহার নিজগুণে নহে।

এতদিন পরে গোরা আবার কোমর বাঁধিল। বলিল, ‘হার মানিব না।’ ষ্টীমারে বসিয়া বসিয়া, আবার দূরে যাইবে, কোনোপ্রকার সূক্ষ্ম বন্ধনে সে নিজের মনকে বাঁধিতে দিবে না, এই সংকল্প আঁটিল।

এমন সময় বিনয়ের সঙ্গে তাহার তর্ক বাধিয়া গেল। বিচ্ছেদের পর বন্ধুর সঙ্গে এই প্রথম মিলনেই তর্ক এমন প্রবল হইত না। কিন্তু আজ এই তর্কের মধ্যে তাহার নিজের সঙ্গেও তর্ক ছিল। এই তর্ক উপলক্ষে নিজের প্রতিষ্ঠাভূমিকে গোরা নিজের কাছেও স্পষ্ট করিয়া লইতেছিল। এইজন্যই গোরা আজ এত বিশেষ জোর দিয়া কথা বলিতেছিল— সেই জোরটুকুতে তার নিজেরই বিশেষ প্রয়োজন ছিল। যখন তাহার আজিকার এই জোর বিনয়ের মনে বিরুদ্ধ জোরকেই উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিল, যখন সে মনে মনে গোরার কথাকে কেবলই খণ্ডন করিতেছিল এবং গোরার নির্বন্ধকে অন্যায় গোঁড়ামি বলিয়া যখন তাহার সমস্ত চিত্ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল তখন বিনয় কল্পনাও করে নাই যে, গোরা নিজেকেই যদি আঘাত না করিত তবে আজ তাহার আঘাত হয়তো এত প্রবল হইত না।

বিনয়ের সঙ্গে তর্কের পর গোরা ঠিক করিল, যুদ্ধক্ষেত্রের বাহিরে গেলে চলিবে না। আমি যদি নিজের প্রাণের ভয়ে বিনয়কে