গোরা
সান্ত্বনা যে ঈশ্বর কোথায় কত জায়গায় রেখেছেন তা সব সময় জানতে পারি নে বলেই আমরা কষ্ট পাই। মা, তুমি লজ্জা করছ, কিন্তু তুমি আমার দুঃসময়ে আমাকে কত সুখ দিয়েছ সে কথা আমি তোমার সামনে না বলেই বা বাঁচি কী করে!”

গোরা গভীর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে সুচরিতার লজ্জিত মুখের দিকে একবার চাহিয়া আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, তোমার দুঃখের দিনে উনি তোমার দুঃখের ভাগ নিতে এসেছিলেন, আবার আজ তোমার সুখের দিনেও তোমার সুখকে বাড়াবার জন্যে এসেছেন— হৃদয় যাঁদের বড়ো তাঁদেরই এইরকম অকারণ সৌহৃদ্য।”

বিনয় সুচরিতার সংকোচ দেখিয়া কহিল, “দিদি, চোর ধরা পড়ে গেলে চতুর্দিক থেকে শাস্তি পায়। আজ তুমি এঁদের সকলের কাছেই ধরা পড়ে গেছ, তারই ফলভোগ করছ। এখন পালাবে কোথায়? আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই চিনি, কিন্তু কারো কাছে কিছু ফাঁস করি নি, চুপ করে বসে আছি— মনে মনে জানি বেশিদিন কিছুই চাপা থাকে না।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন,“তুমি চুপ করে আছ বৈকি। তুমি চুপ করে থাকবার ছেলে কিনা! যেদিন থেকে ও তোমাদের জেনেছে সেইদিন থেকে তোমাদের গুণগান করে ওর আর আশ কিছুতেই মিটছে না।”

বিনয় কহিল, “শুনে রাখো দিদি! আমি যে গুণগ্রাহী এবং আমি যে অকৃতজ্ঞ নই তার সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির।”

সুচরিতা কহিল, “ওতে কেবল আপনারই গুণের পরিচয় দিচ্ছেন।”

বিনয় কহিল, “আমার গুণের পরিচয় কিন্তু আমার কাছে কিছু পাবেন না। পেতে চান তো মা’র কাছে আসবেন— স্তম্ভিত হয়ে যাবেন, ওঁর মুখে যখন শুনি আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। মা যদি আমার জীবনচরিত লেখেন তা হলে আমি সকাল সকাল মরতে রাজি আছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “শুনছ একবার ছেলের কথা!”

গোরা কহিল, “বিনয়, তোমার বাপ-মা সার্থক তোমার নাম রেখেছিলেন।”

বিনয় কহিল, “আমার কাছে বোধ হয় তাঁরা আর কোনো গুণ প্রত্যাশা করেন নি বলেই বিনয় গুণটির জন্যে দোহাই পেড়ে গিয়েছেন, নইলে সংসারে হাস্যাস্পদ হতে হত।”

এমনি করিয়া প্রথম আলাপের সংকোচ কাটিয়া গেল।

বিদায় লইবার সময় সুচরিতা বিনয়কে বলিল, “আপনি একবার আমাদের ও দিকে যাবেন না?”

সুচরিতা বিনয়কে যাইতে বলিল, গোরাকে বলিতে পারিল না। গোরা তাহার ঠিক অর্থটা বুঝিল না, তাহার মনের মধ্যে একটা আঘাত বাজিল। বিনয় যে সহজেই সকলের মাঝখানে আপনার স্থান করিয়া লইতে পারে আর গোরা তাহা পারে না, এজন্য গোরা ইতিপূর্বে কোনোদিন কিছুমাত্র খেদ অনুভব করে নাই— আজ নিজের প্রকৃতির এই অভাবকে অভাব বলিয়া বুঝিল।