প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
ললিতার সঙ্গে তাহার বিবাহ-প্রসঙ্গ আলোচনা করিবার জন্যই যে সুচরিতা বিনয়কে ডাকিয়া গেল, বিনয় তাহা বুঝিয়াছিল। এই প্রস্তাবটিকে সে শেষ করিয়া দিয়াছে বলিয়াই তো ব্যাপারটা শেষ হইয়া যায় নাই। তাহার যতক্ষণ আয়ু আছে ততক্ষণ কোনো পক্ষের নিষ্কৃতি থাকিতে পারে না।
এতদিন বিনয়ের সকলের চেয়ে বড়ো ভাবনা ছিল, গোরাকে আঘাত দিব কী করিয়া। গোরা বলিতে শুধু যে গোরা মানুষটি তাহা নহে; গোরা যে ভাব, যে বিশ্বাস, যে জীবনকে আশ্রয় করিয়া আছে সেটাও বটে। ইহারই সঙ্গে বরাবর নিজেকে মিলাইয়া চলাই বিনয়ের অভ্যাসের এবং আনন্দের বিষয় ছিল; ইহার সঙ্গে কোনোপ্রকার বিরোধ যেন তাহার নিজেরই সঙ্গে বিরোধ।
কিন্তু সেই আঘাতের প্রথম সংকোচটা কাটিয়া গেছে; ললিতার প্রসঙ্গ লইয়া গোরার সঙ্গে একটা স্পষ্ট কথা হইয়া যাওয়াতে বিনয় জোর পাইল। ফোড়া কাটাইবার পূর্বে রোগীর ভয় ও ভাবনার অবধি ছিল না; কিন্তু অস্ত্র যখন পড়িল তখন রোগী দেখিল বেদনা আছে বটে, কিন্তু আরামও আছে, এবং জিনিসটাকে কল্পনায় যত সাংঘাতিক বলিয়া মনে হইয়াছিল ততটাও নহে।
এতক্ষণ বিনয় নিজের মনের সঙ্গে তর্কও করিতে পারিতেছিল না, এখন তাহার তর্কের দ্বারও খুলিয়া গেল। এখন মনে মনে গোরার সঙ্গে তাহার উত্তর-প্রত্যুত্তর চলিতে লাগিল। গোরার দিক হইতে যে-সকল যুক্তিপ্রয়োগ সম্ভব সেইগুলি মনের মধ্যে উত্থাপিত করিয়া তাহাদিগকে নানা দিক হইতে খণ্ডন করিতে লাগিল। যদি গোরার সঙ্গে মুখে মুখে সমস্ত তর্ক চলিতে পারিত তাহা হইলে উত্তেজনা যেমন জাগিত তেমনি নিবৃত্ত হইয়াও যাইত; কিন্তু বিনয় দেখিল, এ বিষয়ে গোরা শেষ পর্যন্ত তর্ক করিবে না। ইহাতেও বিনয়ের মনে একটা উত্তাপ জাগিল; সে ভাবিল— গোরা বুঝিবে না, বুঝাইবে না, কেবলই জোর করিবে। ‘জোর! জোরের কাছে মাথা হেঁট করিতে পারিব না।’ বিনয় কহিল, ‘যাহাই ঘটুক আমি সত্যের পক্ষে।’ এই বলিয়া ‘সত্য’ বলিয়া একটি শব্দকে দুই হাতে সে বুকের মধ্যে আঁকড়িয়া ধরিল। গোরার প্রতিকূলে একটি খুব প্রবল পক্ষকে দাঁড় করানো দরকার— এইজন্য, সত্যই যে বিনয়ের চরম অবলম্বন ইহাই সে বার বার করিয়া নিজের মনকে বলিতে লাগিল। এমন-কি, সত্যকেই সে যে আশ্রয় করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া নিজের প্রতি তাহার ভারি একটা শ্রদ্ধা জন্মিল। এইজন্য বিনয় অপরাহ্নে সুচরিতার বাড়ির দিকে যখন গেল তখন বেশ একটু মাথা তুলিয়া গেল। সত্যের দিকেই ঝুঁকিয়াছে বলিয়া তাহার এত জোর, না, ঝোঁকটা আর-কিছুর দিকে সে কথা বিনয়ের বুঝিবার অবস্থা ছিল না।
হরিমোহিনী তখন রন্ধনের উদ্যোগ করিতেছিলেন। বিনয় সেখানে রন্ধনশালার দ্বারে ব্রাহ্মণতনয়ের মধ্যাহ্নভোজনের দাবি মঞ্জুর করাইয়া উপরে চলিয়া গেল।
সুচরিতা একটা সেলাইয়ের কাজ লইয়া সেই দিকে চোখ নামাইয়া অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে আলোচ্য কথাটা পাড়িল। কহিল, “দেখুন বিনয়বাবু, ভিতরকার বাধা যেখানে নেই সেখানে বাইরের প্রতিকূলতাকে কি মেনে চলতে হবে?”
গোরার সঙ্গে যখন তর্ক হইয়াছিল তখন বিনয় বিরুদ্ধ যুক্তি প্রয়োগ করিয়াছে। আবার সুচরিতার সঙ্গে যখন আলোচনা হইতে লাগিল তখনো সে উলটা পক্ষের যুক্তি প্রয়োগ করিল। তখন গোরার সঙ্গে তাহার যে কোনো মতবিরোধ আছে এমন কথা কে মনে করিতে পারিবে!
বিনয় কহিল, “দিদি, বাইরের বাধাকে তোমরাও তো খাটো করে দেখছ না!”
সুচরিতা কহিল, “তার কারণ আছে বিনয়বাবু! আমাদের বাধাটা ঠিক বাইরের বাধা নয়। আমাদের সমাজ যে আমাদের ধর্মবিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আপনি যে সমাজে আছেন সেখানে আপনার বন্ধন কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধন। এইজন্যে যদি