গোরা
বাধিয়ে বসে, তার পরে যখন একেবারে দম আটকে আসে তখন বলেন, বসে বসে ভাবো। তোমরা স্থির হয়ে বসে ভাবতে পার, কিন্তু আমাদের যে প্রাণ বেরিয়ে গেল।”

বিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুধীর রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। রীতিমত আহারে বসিয়া খাইবার পূর্বেই চাখিবার ইচ্ছা যেমন, সুধীরের সেইরূপ চঞ্চলতা উপস্থিত হইয়াছে। তাহার ইচ্ছা এখনই বিনয়কে বন্ধুসমাজে ধরিয়া লইয়া গিয়া সুসংবাদ দিয়া আনন্দ-উৎসব আরম্ভ করিয়া দেয়, কিন্তু সুধীরের এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অভিঘাতে বিনয়ের মন আরো দমিয়া যাইতে লাগিল। সুধীর যখন প্রস্তাব করিল “বিনয়বাবু, আসুন-না আমরা দুজনে মিলেই পানুবাবুর কাছে যাই”, তখন সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া জোর করিয়া তাহার হাত ছাড়াইয়া বিনয় চলিয়া গেল।

কিছু দূরে যাইতেই দেখিল, অবিনাশ তাহার দলের দুই-একজন লোকের সঙ্গে হন্ হন্ করিয়া কোথায় চলিয়াছে। বিনয়কে দেখিয়াই অবিনাশ কহিল, “এই-যে বিনয়বাবু, বেশ হয়েছে। চলুন আমাদের সঙ্গে।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাচ্ছ?”

অবিনাশ কহিল, “কাশীপুরের বাগান ঠিক করতে যাচ্ছি। সেইখানে গৌরমোহনবাবুর প্রায়শ্চিত্তের সভা বসবে।”

বিনয় কহিল, “না, আমার এখন যাবার জো নেই।”

অবিনাশ কহিল, “সে কী কথা! আপনারা কি বুঝতে পারছেন এটা কত বড়ো একটা ব্যাপার হচ্ছে! নইলে গৌরমোহনবাবু কি এমন একটা অনাবশ্যক প্রস্তাব করতেন? এখনকার দিনে হিন্দুসমাজকে নিজের জোর প্রকাশ করতে হবে। এই গৌরমোহনবাবুর প্রায়শ্চিত্তে দেশের লোকের মনে কি একটা কম আন্দোলন হবে। আমরা দেশ বিদেশ থেকে বড়ো বড়ো ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আনব। এতে সমস্ত হিন্দুসমাজের উপরে খুব একটা কাজ হবে। লোকে বুঝতে পারবে এখনো আমরা বেঁচে আছি। বুঝতে পারবে হিন্দুসমাজ মরবার নয়।”

অবিনাশের আকর্ষণ এড়াইয়া বিনয় চলিয়া গেল।

৫৬

হারানবাবুকে যখন বরদাসুন্দরী ডাকিয়া সকল কথা বলিলেন তখন তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন এবং কহিলেন, “এ সম্বন্ধে একবার ললিতার সঙ্গে আলোচনা করে দেখা কর্তব্য।”

ললিতা আসিলে হারানবাবু তাঁহার গাম্ভীর্যের মাত্রা শেষ সপ্তক পর্যন্ত চড়াইয়া কহিলেন, “দেখো ললিতা, তোমার জীবনে খুব একটা দায়িত্বের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। এক দিকে তোমার ধর্ম আর-এক দিকে তোমার প্রবৃত্তি, এর মধ্যে তোমাকে পথ নির্বাচন করে নিতে হবে।”

এই বলিয়া একটু থামিয়া হারানবাবু ললিতার মুখের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করিলেন। হারানবাবু জানিতেন তাঁহার এই ন্যায়াগ্নিদীপ্ত দৃষ্টির সম্মুখে ভীরুতা কম্পিত হয়, কপটতা ভস্মীভূত হইয়া যায়— তাঁহার এই তেজোময় আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ব্রাহ্মসমাজের একটি মূল্যবান সম্পত্তি।

ললিতা কোনো কথা বলিল না, চুপ করিয়া রহিল।

হারানবাবু কহিলেন, “তুমি বোধ হয় শুনেছ, তোমার অবস্থার প্রতি দৃষ্টি করে অথবা যে কারণেই হোক বিনয়বাবু অবশেষে আমাদের সমাজে দীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন।”

ললিতা এ সংবাদ পূর্বে শুনে নাই, শুনিয়া তাহার মনে কী ভাব হইল তাহাও প্রকাশ করিল না; তাহার দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া