প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
হরিমোহিনী যতদিন পরেশবাবুর বাড়িতে ছিলেন ততদিন বিনয়ের প্রতি তাঁহার খুব একটা আকর্ষণ ছিল। কিন্তু যখন হইতে সুচরিতাকে লইয়া তাঁহার স্বতন্ত্র ঘরকন্না হইয়াছে তখন হইতে ইহাদের যাতায়াত তাঁহার কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হইয়া উঠিয়াছিল। আজকাল আচারে বিচারে সুচরিতা যে সম্পূর্ণ তাঁহাকে মানিয়া চলে না এই-সকল লোকের সঙ্গদোষকেই তিনি তাহার কারণ বলিয়া ঠিক করিয়াছিলেন। যদিও তিনি জানিতেন, বিনয় ব্রাহ্ম নহে, তবু বিনয়ের মনের মধ্যে যে কোনো হিন্দু-সংস্কারের দৃঢ়তা নাই তাহা তিনি স্পষ্ট অনুভব করিতেন। তাই এখন তিনি পূর্বের ন্যায় উৎসাহের সহিত এই ব্রাহ্মণতনয়কে ডাকিয়া লইয়া ঠাকুরের প্রসাদের অপব্যয় করিতেন না।
আজ প্রসঙ্গক্রমে হরিমোহিনী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন,“আচ্ছা বাবা, তুমি তো ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু সন্ধ্যা-অর্চনা কিছুই কর না?”
বিনয় কহিল, “মাসি, দিনরাত্রি পড়া মুখস্থ করে করে গায়ত্রী সন্ধ্যা সমস্তই ভুলে গেছি।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “পরেশবাবুও তো লেখাপড়া শিখেছেন। উনি তো নিজের ধর্ম মেনে সকালে সন্ধ্যায় একটা-কিছু করেন।”
বিনয় কহিল, “মাসি, উনি যা করেন তা কেবল মন্ত্র মুখস্থ করে করা যায় না। ওঁর মতো যদি কখনো হই তবে ওঁর মতো চলব।”
হরিমোহিনী কিছু তীব্রস্বরে কহিলেন,“ততদিন নাহয় বাপ-পিতামহর মতোই চলো-না। না এ দিক না ও দিক কি ভালো? মানুষের একটা তো ধর্মের পরিচয় আছে। না রাম না গঙ্গা, মা গো, এ কেমনতরো!”
এমন সময় ললিতা ঘরে প্রবেশ করিয়াই বিনয়কে দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। হরিমোহিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, “দিদি কোথায়?”
হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানী নাইতে গেছে।”
ললিতা অনাবশ্যক জবাবদিহির স্বরূপ কহিল, “দিদি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “ততক্ষণ বোসো-না, এখনই এল বলে।”
ললিতার প্রতিও হরিমোহিনীর মন অনুকূল ছিল না। হরিমোহিনী এখন সুচরিতাকে তাহার পূর্বের সমস্ত পরিবেষ্টন হইতে ছাড়াইয়া লইয়া সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্ত করিতে চান। পরেশবাবুর অন্য মেয়েরা এখানে তেমন ঘন ঘন আসে না, একমাত্র ললিতাই যখন-তখন আসিয়া সুচরিতাকে লইয়া আলাপ-আলোচনা করিয়া থাকে, সেটা হরিমোহিনীর ভালো লাগে না। প্রায় তিনি উভয়ের আলাপে ভঙ্গ দিয়া সুচরিতাকে কোনো-একটা কাজে ডাকিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করেন, অথবা, আজকাল পূর্বের মতো সুচরিতার পড়াশুনা অব্যাঘাতে চলিতেছে না বলিয়া আক্ষেপ প্রকাশ করেন। অথচ, সুচরিতা যখন পড়াশুনায় মন দেয় তখন অধিক পড়াশুনা যে মেয়েদের পক্ষে অনাবশ্যক এবং অনিষ্টকর সে কথাও বলিতে ছাড়েন না। আসল কথা, তিনি যেমন করিয়া সুচরিতাকে অত্যন্ত ঘিরিয়া লইতে চান কিছুতেই তাহা পারিতেছেন না বলিয়া কখনো বা সুচরিতার সঙ্গীদের প্রতি, কখনো বা তাহার শিক্ষার প্রতি কেবলই দোষারোপ করিতেছেন।
ললিতা ও বিনয়কে লইয়া বসিয়া থাকা যে হরিমোহিনীর পক্ষে সুখকর তাহা নহে, তথাপি তাহাদের উভয়ের প্রতি রাগ করিয়াই তিনি বসিয়া রহিলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, বিনয় ও ললিতার মাঝখানে একটি রহস্যময় সম্বন্ধ ছিল। তাই তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘তোমাদের সমাজে যেমন বিধিই থাক্, আমার এ বাড়িতে এই-সমস্ত নির্লজ্জ মেলামেশা, এই-সব খৃস্টানি কাণ্ড ঘটিতে দিব না।’