প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
তবু পরেশবাবু তাহাকে আরো কিছুদিনের সময় লইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। তাহাতে বিনয় ভাবিল তাহার দৃঢ়তার উপর পরেশবাবুর বুঝি সংশয় আছে। সুতরাং তাহার জেদ ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তাহার মন যে একটি নিঃসন্দিগ্ধ ক্ষেত্রে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, কিছুতেই তাহার আর কিছুমাত্র হেলিবার টলিবার সম্ভাবনা নাই, ইহাই বার বার করিয়া জানাইল। উভয় পক্ষ হইতেই ললিতার সঙ্গে বিবাহের কোনো প্রসঙ্গই উঠিল না।
এমন সময় গৃহকর্ম-উপলক্ষে বরদাসুন্দরী সেখানে প্রবেশ করিলেন। যেন বিনয় ঘরে নাই এমনি ভাবে কাজ সারিয়া তিনি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। বিনয় মনে করিয়াছিল, পরেশবাবু এখনই বরদাসুন্দরীকে ডাকিয়া বিনয়ের নূতন খবরটি তাঁহাকে জানাইবেন। কিন্তু পরেশবাবু কিছুই বলিলেন না। বস্তুত এখনো বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়া তিনি মনেই করেন নাই। এ কথাটি সকলের কাছেই গোপন রাখিতে তিনি ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু বরদাসুন্দরী বিনয়ের প্রতি যখন সুস্পষ্ট অবজ্ঞা ও ক্রোধ প্রকাশ করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, তখন বিনয় আর থাকিতে পারিল না। সে গমনোন্মুখ বরদাসুন্দরীর পায়ের কাছে মাথা নত করিয়া প্রণাম করিল এবং কহিল, “আমি ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেবার প্রস্তাব নিয়ে আজ আপনাদের কাছে এসেছি। আমি অযোগ্য, কিন্তু আপনারা আমাকে যোগ্য করে নেবেন এই আমার ভরসা।”
শুনিয়া বিস্মিত বরদাসুন্দরী ফিরিয়া দাঁড়াইলেন এবং ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিয়া বসিলেন। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পরেশবাবুর মুখের দিকে চাহিলেন।
পরেশ কহিলেন, “বিনয় দীক্ষা গ্রহণ করবার জন্যে অনুরোধ করছেন।”
শুনিয়া বরদাসুন্দরীর মনে একটা জয়লাভের গর্ব উপস্থিত হইলে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ আনন্দ হইল না কেন? তাঁহার ভিতরে ভিতরে ভারি একটা ইচ্ছা হইয়াছিল, এবার যেন পরেশবাবুর রীতিমত একটা শিক্ষা হয়। তাঁহার স্বামীকে প্রচুর অনুতাপ করিতে হইবে এই ভবিষ্যদ্বাণী তিনি খুব জোরের সঙ্গে বার বার ঘোষণা করিয়াছিলেন। সেইজন্য সামাজিক আন্দোলনে পরেশবাবু যথেষ্ট বিচলিত হইতেছিলেন না দেখিয়া বরদাসুন্দরী মনে মনে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিলেন। হেনকালে সমস্ত সংকটের এমন সুচারুরূপে মীমাংসা হইয়া যাইবে ইহা বরদাসুন্দরীর কাছে বিশুদ্ধপ্রীতিকর হয় নাই। তিনি মুখ গম্ভীর করিয়া কহিলেন, “এই দীক্ষার প্রস্তাবটা আর কিছুদিন আগে যদি হত তা হলে আমাদের এত অপমান এত দুঃখ পেতে হত না।”
পরেশবাবু কহিলেন, “আমাদের দুঃখকষ্ট-অপমানের তো কোনো কথা হচ্ছে না, বিনয় দীক্ষা নিতে চাচ্ছেন।”
বরদাসুন্দরী বলিয়া উঠিলেন, “শুধু দীক্ষা?”
বিনয় কহিলেন, “অন্তর্যামী জানেন আপনাদের দুঃখ-অপমান সমস্তই আমার।”
পরেশ কহিলেন, “দেখো বিনয়, তুমি ধর্মে দীক্ষা নিতে যে চাচ্ছ সেটাকে একটা অবান্তর বিষয় কোরো না। আমি তোমাকে পূর্বেও একদিন বলেছি, আমরা একটা কোনো সামাজিক সংকটে পড়েছি কল্পনা করে তুমি কোনো গুরুতর ব্যাপারে প্রবৃত্ত হোয়ো না।”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু তাও বলি, আমাদের সকলকে জালে জড়িয়ে ফেলে চুপ করে বসে থাকাও ওঁর কর্তব্য নয়।”
পরেশবাবু কহিলেন, “চুপ করে না থেকে চঞ্চল হয়ে উঠলে জালে আরো বেশি করে গ্রন্থি পড়ে। কিছু একটা করাকেই যে কর্তব্য বলে তা নয়, অনেক সময় কিছু না করাই হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়ো কর্তব্য।”
বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হবে, আমি মূর্খ মানুষ, সব কথা ভালো বুঝতে পারি নে। এখন কী স্থির হল সেই কথাটা জেনে