গোরা
দিতে হয়, তা হলে গুরুতর বিষয়ে একটা মত গ্রহণ বা পরিবর্তনের সময় মানুষ নিজের সমস্ত বুদ্ধিকে জাগাবে কেন? সত্যকে যথার্থ সত্য বলেই গ্রহণ করছি কি না মানুষকে তার পরীক্ষা দেওয়া চাই। দণ্ড স্বীকার করতেই হবে। মূল্যটা এড়িয়ে রত্নটুকু পাবে সত্যের কারবার এমন শৌখিন কারবার নয়।”

তর্কের মুখে আর-কোনো বল্‌গা রহিল না। কথার উপরে কথা বাণের উপরে বাণের মতো আসিয়া পড়িয়া পরস্পর সংঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিতে লাগিল।

অবশেষে অনেকক্ষণ বাগ্‌যুদ্ধের পর বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “গোরা, তোমার এবং আমার প্রকৃতির মধ্যে একটা মূলগত প্রভেদ আছে। সেটা এতদিন কোনোমতে চাপা ছিল— যখনই মাথা তুলতে চেয়েছে আমিই তাকে নত করেছি, কেননা, আমি জানতুম যেখানে তুমি কোনো পার্থক্য দেখ সেখানে তুমি সন্ধি করতে জান না, একেবারে তলোয়ার হাতে ছুটতে থাক। তাই তোমার বন্ধুত্বকে রক্ষা করতে গিয়ে আমি চিরদিনই নিজের প্রকৃতিকে খর্ব করে এসেছি। আজ বুঝতে পারছি এতে মঙ্গল হয় নি এবং মঙ্গল হতে পারে না।”

গোরা কহিল, “এখন তোমার অভিপ্রায় কী আমাকে খুলো বলো।”

বিনয় কহিল, “আজ আমি একলা দাঁড়ালুম। সমাজ ব’লে রাক্ষসের কাছে প্রতিদিন মানুষ-বলি দিয়ে কোনোমতে তাকে ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে এবং যেমন করে হোক তারই শাসনপাশ গলায় বেঁধে বেড়াতে হবে, তাতে প্রাণ থাক্‌ আর না-থাক্‌, এ আমি কোনোমতেই স্বীকার করতে পারব না।”

গোরা কহিল, “মহাভারতের সেই ব্রাহ্মণশিশুটির মতো খড়কে নিয়ে বকাসুর বধ করতে বেরোবে না কি?”

বিনয় কহিল, “আমার খড়কেতে বকাসুর মরবে কি না তা জানি নে, কিন্তু আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবার অধিকার যে তার আছে এ কথা আমি কোনোমতেই মানব না— যখন সে চিবিয়ে খাচ্ছে তখনো না।”

গোরা কহিল, “এ-সমস্ত তুমি রূপক দিয়ে কথা বলছ, বোঝা কঠিন হয়ে উঠছে।”

বিনয় কহিল, “বোঝা তোমার পক্ষে কঠিন নয়, মানাই তোমার পক্ষে কঠিন। মানুষ যেখানে স্বভাবত স্বাধীন, ধর্মত স্বাধীন, আমাদের সমাজ সেখানে তার খাওয়া-শোওয়া-বসাকেও নিতান্ত অর্থহীন বন্ধনে বেঁধেছে এ কথা তুমি আমার চেয়ে কম জান তা নয় ; কিন্তু এই জবরদস্তিকে তুমি জবরদস্তির দ্বারাই মানতে চাও। আমি আজ বলছি, এখানে আমি কারও জোর মানব না। সমাজের দাবিকে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বীকার করব যতক্ষণ সে আমার উচিত দাবিকে রক্ষা করবে। সে যদি আমাকে মানুষ বলে গণ্য না করে, আমাকে কলের পুতুল করে বানাতে চায়, আমিও তাকে ফুলচন্দন দিয়ে পূজা করব না— লোহার কল বলেই গণ্য করব।”

গোরা কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি ব্রাহ্ম হবে?”

বিনয় কহিল, “না।”

গোরা কহিল, “ললিতাকে তুমি বিয়ে করবে?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুবিবাহ?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা। পরেশবাবু তাতে সম্মত আছেন?

বিনয়। এই তাঁর চিঠি।

গোরা পরেশের চিঠি দুইবার করিয়া পড়িল। তাহার শেষ অংশে ছিল—